সেই পনেরো আগস্ট, পঁচাত্তর; প্রভাতের সূর্যের লালিমা
নদীরূপ বয়ে যায়! এমন তীর্যক আলো নামে অকস্মাৎ
ওই বত্রিশ নম্বরে। ফজর-নামাজ শেষে ইথারে ইথারে
ভেসে আসে সেই কথা- ''আমি (পাপিষ্ট) মেজর ডালিম বলছি-  
শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।
খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে
                         সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে।
সারাদেশে কার্ফু জারি করা হয়েছে।''
বাংলাদেশ বেতার সহসা হয়ে গেলো রেডিও বাংলাদেশ!
একাত্তরে পরাজিত দুর্বৃত্ত, হার্মাদ পাকিস্তানী কায়দায়।
ইসলামিক গানের হামদ ও নাত বেজে চলে ঘন ঘন,
ক্ষণে ক্ষণে ঘোষণার আওয়াজ আসে দুর্বৃত্তের কণ্ঠে থেকে-
'আমি মেজর ডালিম বলছি...'।


নীরর নিস্তব্দ পথ, কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনা নেই;
নেই রিক্সার টুংটাং, গাড়ির ভেঁপুর স্বর, নেই কোলাহল।
হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে গিয়েছে পরমকথার সেই
নির্মম দৈত্যের আক্রমনে। ঠাকুরমা-ঝুলির কল্পলোকের
মৃতরাজপুরী এই ঢাকার শহর!


কী আশ্চর্য! সুনসান নিস্তব্ধতা, সন্ত্রস্ত, স্তম্ভিত জনগণ!
ফিসফাস করে, 'আহা, উঁহু' শব্দে তারা কথা বলে যায় শুধু।
খাপছাড়া জিজ্ঞাসু প্রশ্নের ছড়াছড়ি- 'এ ব্যাপারটা কি সত্যি!
শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, এমন অপশক্তি কার?
কে এমন নির্দয় সীমার! এতো পাষণ্ড! দুর্বৃত্ত কুলাঙ্গার!
উৎসুক জনতার হৃদয়ে অনেক ভয়, এই বুঝি এলো
নিদারুণ একচোখা দৈত্যের চরেরা উলঙ্গ উল্লাস করে।
এই বুঝি তারা এলো, বুলেট ছুঁড়লো, চার্জ করলো বেওনেট!
এই বুঝি সেই পাপিষ্ঠেরা হাতকড়া দেবে আমাদের হাতে!
শঙ্কিত চেতনে সকলের মনে মনে ভয় ঢুকে গেছে আজ।
মৃত্যভয়, পরিবার পরিজন চিরতরে হারাবার ভয়।
আতঙ্কের নদীজলে প্রবাহিত আমাদের প্রতিটি সময়।
প্রভাতের বিহঙ্গেরা আজ যেনো ভুলে গেছে তাহাদের গান;
অথচ, প্রভাতকালে লক্ষ-হাজার পাখির কিচিরমিচিরে
প্রকৃতির পরিবেশে আমোদিত, তোলপাড় হওয়ারই কথা।


এমন নিস্তব্ধতার ভেতরে, ভয়সঙ্কুল মানুষের মাঝে
কয়েকজন শৈশব পেরোনো কিশোর দুরন্ত সাহস নিয়ে,
নিত্যদিনকার মতো, দেয়ালে সাঁটানো প্রত্রিকা পড়তে যাই।
দৈনিক আজাদে শেখ মুজিব হত্যার কোন সমাচার নাই।
আজাদের মোড় থেকে হেঁটে হেঁটে বেবি আইসক্রিমের মোড়ে
দেখি, আরো কিছু ভয়ার্ত মানুষ সেইখানে জড়ো হয়ে আছে।
কিশোরেরা নিরাশার ছবি এঁকে চুপচাপ দাঁড়ালো সেথায়।
সহসা জলপাই রঙা একখানি লরিগাড়ি পূর্বদিক হতে
পশ্চিমের দিকে আসে; পলাশীর মোড় থেকে হুঁসহুঁস শব্দে;
ভীত সন্ত্রস্ত সেসব জনতার দল আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।
দশ কিংবা বারজন জোয়ান, পরনে মিশমিশে কালো উর্দি,
সেনাদের চোখগুলো রক্তজবার মতোন টকটকে লাল!
ওরা কি পিপাষার্ত চণ্ডীর তুষ্টির উদ্দেশ্যে বলী দিয়ে এলো?
ওরা কি প্রভাতের সূর্যের গায়ে রক্তের ধারা ছড়িয়ে এলো?
হয়তো বা তাই, না হলে ভোরের সূর্য এতো লাল হবে কেনো!


সরকারি কলোনীর দেয়ালঘেষা পুরোনো আমগাছগুলো,
বেবি আইসক্রিমের মোড়ের বিশাল পুরোনো জামগাছটি,
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বাস্তার সারিবদ্ধ রেইনট্রি,
নির্বাক, স্থবির। অনন্তকালের জন্য বিষন্নে দাঁড়িয়ে আছে।
এসব বৃক্ষের কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা এবং পত্র-ফুল-ফল
একটুও নড়ছে না। বাতাসেরা দমবন্ধ, নিস্তরঙ্গভাবে
মৃতবৎ পড়ে আছে। সব নীরবতা ভেঙ্গে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে
ব্রেক কষলো গাড়িটি। ইডেন মহিলা কলেজের বিপরীতে।
তারা আজিমপুর কবরস্থানের দিকে তাকালো সকলে।
কোন ভাবান্তর হলো না, তাদের চোখে মুখে ভাবে ভঙ্গিমায়।
নির্বিকার মদমত্ত জংলি শুয়োরের মতো ঘোঁৎঘোৎ করে
কয়েকজন সৈনিক ধুপধাপ নেমে এলো কমাণ্ডো স্টাইলে।
তাদের লোমশ হাতে এলএমজির নল শক্ত করে ধরা;
যেন রণাঙ্গনে হননের স্পৃহা চোখেমুখে আছড়ে পড়ছে।
একজন অল্পবয়সী সৈনিক চিৎকার করে বলে যায়-
'আপনারা রাস্তা থেকে বাড়ি চলে যান, শহরে কার্ফু চলছে,
নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করুন...'।


উনসত্তরের গণআন্দোলনকালে কোন কার্ফুর নির্দেশ
মানিনি আমরা। পরিত্যাক্ত এটা-সেটা, রেললাইনের পাত,
টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বেড়িকেড দিতাম।
এইসব বেড়িকেড সরিয়ে পাকসেনারা চলে গেলে পরে,
আমরা আবার এসে বেড়িকেড দিলে; আবার সরিয়ে দিতো।
যেন কার্টুনের হাস্যকর ইঁদুর বিড়াল খেলা অবিরাম!


কেউ কেউ ভদ্র ও বাধ্য ছাত্রের ন্যায় উঁচু ঘাড় নিচু করে
বাড়ির পথের রাস্তা মাপে; প্রতিবাদহীন সুবোধের মতো।
কেউ কেউ উৎসুক চোখে চেয়ে আছে আড়ালে আবডাল থেকে।
কারোর মুখে রা নেই, কথা নেই, যেন কথা বলা ভুলে গেছে
বহু বহু শতবছর আগের থেকে; কিন্তু, চোখের দৃষ্টিতে
লক্ষজনমের হাজার কথা। সৈনিকেরা আবার লাফির উঠে
লরির উপরে। বানরেরা যেমন এ-ডাল থেকে অন্য ডালে
লাফিয়ে লাফিয়ে চলে; তেমন করেই জলপাই রঙা গাড়িটি
শোঁ শোঁ করে ছুটে বত্রিশ নম্বর লক্ষ্যে নিউমার্কেটের দিকে।


আমরা এগিয়ে যাই  ইডেন কলেজ পাড় হয়ে নীলক্ষেতে,
বলাকা হলের কাছে। এমন জনবহুলস্থানে, নিউমার্কেটে,
রাস্তায় মানুষ নেই। যে কটা বেওয়ারিশ কুকুরের ছানা
এইসব এলাকার পথে ইতস্ততভাবে ঘোরাফেরা করে,
তাদের সমসংখ্যক মানুষের চলাচল নেই রাজপথে।
ধানকাটা শেষ হলে, অগ্রহায়নের শেষে, প্রখর দুপুরে
নিস্তরঙ্গ খোলামাঠে যেমন লক্ষ ঝিঁঝিঁর সুর শোনা যায়;
তেমনই অলৌকিক নৈশব্দের সুর নিউমার্কেটের রাস্তায়।
নীলক্ষেতের টংঘরের বই থেকে, আজিমপুর কলোনীর
সারি সারি সব হলুদ দালান থেকে, গাছের পাতা থেকে,
ডাস্টবিনের ময়লা থেকে, খোলা নর্মদায় গড়িয়ে যাওয়ার
জল থেকে ভেসে উঠে; বিরহ-বেদনা, করুণ কান্নার সুর।
সকালের লাল আলোগুলো তীব্র সাদা আর তীক্ষ্ম হতে থাকে;
চোখ ঝলসিয়ে ওঠে, লক্ষ লক্ষ বছরের অন্ধকার নামে
এই পৃথিবীর বুকে। আমরা সেই সকল কিশোরের দল
কোলাহলহীন নিউমার্কটকে পিছনে ফেলে ঘরে ফিরে যাই।


স্বাধীন বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অগ্রনায়ক!
বাঙালি জাতির প্রবাদপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান!
বত্রিশ নম্বরের সিঁড়ির ঢালুতে নির্বাক, পড়ে আছো তুমি।
এবং তোমার স্বজনেরা শেফালির মতো শিশিরের মাঝে
মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দোতলার বেডরুমে, টানা বারান্দায়,
টয়লেটে, গেস্টরুমে,প্যাসেজে, রক্তাক্তভাবে অবিন্যস্তভাবে।
এ সকল কথা ভাবতে ভাবতে পিছনের দিকে ফিরে আসি,
জ্বলন্ত চোখের কোণে বিষন্নতা, উত্তাল জলধি বয়ে যায়!


১৬/০৮/২০২২
মিরপুর, ঢাকা।