(গ্রীক উপাখ্যানের অমর প্রেমগাঁথার আলোকে কাহিনীকাব্য)


ছন্দের দেবী ক্যালিওপ, রাজা এ্যাপোলোকে বিয়ে করে,
তাঁদের মিলনে অর্ফিয়াসের জন্ম ধরার 'পরে।
অর্ফিয়াসের বাঁশি-ঝংকারে সুরের লহরী ওড়ে,
আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তা' নিক্কণ মধু-সুরে।
ভুলে যায় সবে জীবনের কথা বিশ্ব-জগত বাঁকে,
হিংস্র পশুরা ভুলে গিয়ে রাগ, অবাক তাকিয়ে থাকে।
এমন মধুর সুরের বাঁশুরী বাজিছে বিশ্বময়,
তা শুনে কিশোরী ইউরিডিসও অভিভূত, বিস্ময়!
মোহিত বালিকা সারাদিনমান তন্ময় হয়ে রয়,
দিবসের খেলা, রাতের নিদ্রা ভুলে যায় সমুদয়।
বিমোহিত রয় সুরের জগতে বীণা-তার ঝংকারে,
ইউরিডিসকে অর্ফিয়াসের অন্তরে ঢের ধরে।


প্রফুল্লতায় বাঁশির ছিদ্রে আনন্দময় সুর;
পরস্পরের ভালোবাসা দিয়ে বেঁধেছে বিয়ের ডোর।
মনের খুশিতে গৃহ ছেড়ে দোঁহে হলো যে দেশান্তর,
দেশ থেকে দেশে আনন্দতায় ঘুরছে নিরন্তর।
দেশে দেশে ভ্রমে, বাঁশুরী বাজায় আনন্দ আয়োজনে,
অর্ফিয়াসের বাঁশুরির সুর ইউরিডিসও শোনে।
আরো শোনে যত পশু-পাখিদলে, শোনে তা' পাহাড়-নদী,
তন্ময়ী বনে লতা-পাতা শোনে বিহ্বলে নিরবধি।
বাঁশি-ঝংকারে সুরের লহরী আকাশে বাতাসে ওঠে,
সুরের তালেতে নদী ও সাগর দুলিয়া দুলিয়া ছোটে।


কিন্তু, তাঁদের আনন্দধারা রইলো না বেশীক্ষণ,
আশিবিষে এসে ইউরিডিসকে করে যায় দংশন।
অর্ফিয়াসের প্রেমিকা নিহত! শোকে-দুখে ভেঙে পড়ে।
হাহাকার উঠে বিষাদের সুরে বাঁশির ছিদ্র ফুঁড়ে।
বিরহের সুরে বাঁশুরি বাজায়ে চলিছে অর্ফিয়াস,
পাগলের ন্যায় কাঁদে আর হাঁটে, কাঁধে প্রেমিকার লাশ।
এমনি করিয়া বহুদিন পরে এসেছে 'অলিম্পাসে',
যেথা দেবরাজ জুপিটার ছিলো ধ্যানমগ্নেতে বসে।
বিষাদিত সুরে দেবরাজ-ধ্যান, তছনছ হয়ে যায়,
দুঃখের সুরে ব্যথিত মুণির মমতা বাড়িলো তায়।
বলে, ''হে যুবক! পাতালপুরিতে যাও; আছে যমরাজ!
খুশি করে তাঁরে তোমার প্রিয়ারে ফিরানো তোমার কাজ।
কিন্ত, স্মরণে রাখিও, সে এক বড়োই কঠিন সাধ,
ভুল যদি করো জীবন তোমার হয়ে যাবে বরবাদ''।


ভালোবাসা যেথা বসবাস করে জীবন তুচ্ছ সেথা,
দুরুহ কাজেও প্রেমিকেরা প্রাণ বাজি রাখে যথাতথা।
ভয়হীন মনে বাঁশি হাতে নিয়ে পাতাল রাজ্যে চলে,
জীবনের মায়া তুচ্ছ করে সে বেদনার সুর তোলে।
পাতালপুরির সিংহদ্বারেতে ত্রিমুণ্ড সারমেয়ে
পাহারা দিচ্ছে, কঠিন কঠোর সিংহের তেজ লয়ে।
অর্ফিয়াসকে দেখে সে কুকুর রাগতঃ নয়নে চায়,
মুখ দিয়ে ছোটে আগুনের ধারা বিশাল ড্রাগন প্রায়।
নির্ভয়ী প্রেমী বাঁশুরি বাজায় নেই কোন হুঁশ তার,
বাঁশির সুরেতে ত্রিমাথা-কুকুর শান্ত হয় এবার।


পাতালপুরিতে প্রবেশ করিলো সূর্য ওঠার আগে,
নরক-আঁধার তীব্র আগুন হুঙ্কার করে জাগে।
অকুতোভয়ের অর্ফিয়াসেও ধীরপদে হেঁটে যায়,
নরকের পাপী চিৎকার করে প্রচণ্ড পিপাসায়।
আকণ্ঠ জলে ডুবে তড়পায়, যখন চাহে সে জল,
জলগুলো সব ভোজবাজিরূপে অদৃশ্য অবিরল।
অর্ফিয়াসের বাঁশির সুরেতে অনন্য এক যাদু!
নরক তখন শান্ত-সুবোধ স্তব্ধ-সুশীল সাধু।
সঙ্গীত শুনে ভুলে গেলো যেন পাপীতাপী সবে, হায়!
নরক প্রহরী বিমুগ্ধতায় সুরে সুরে নেচে যায়।


সব কিছু ঠেলে ধীরে ধীরে চলে প্রেমিক অর্ফিয়াস,
সম্ভ্রম-মনে সমুখে দাঁড়ায় ভীষণ বিনীত ভাষ।
যমরাজ প্লুটো আর তার রানী দুজনেই রহে চেয়ে,
তাঁদের নিকটে নিয়তিত্রয়ীরা খেলিছে সূত্র লয়ে।
একজন টানে নিয়তির সুতো, অন্যজনে পাকায়,
আরেক জনায় কাঁচি দিয়ে শুধু নিয়মিত কেটে যায়।
সঙ্গীত শুনে বেদনা বিধুর খুশি হলো যমরাজ,
নিয়তিত্রয়ও প্রসন্ন হয় বাঁশুরির সুরে আজ।
যমরাজ-প্রতি অর্ফিয়াসের সবিনয় কুর্ণিশ-
''ফিরায়ে দাও, হে মহাময় প্রভু! আমার ইউরিডিস।
মোর প্রেমিকার প্রাণ দাও''; বলে, ছাড়িয়া দীর্ঘশ্বাস,
শুনে সব প্লুটো যমরাজ বলে, ''শুন হে অর্ফিয়াস!
স্বর্গ হইতে চলে যাবে তুমি তাকাবে না পিছুপানে,
ফিরে পাবে ফের প্রেমিকা তোমার ভালোবাসা-সম্মানে।
যদি এ বচন না-রাখো স্মরণ পাবে নাকো তাকে আর,
মিছে হয়ে যাবে কামনা সকল, জগতের সংসার।
স্বর্গ-সীমানা পার হলে পাবে ইউরিডিসের রূপ'',
এই বলে সেই যমরাজ হলো পাহাড়ের ন্যায় চুপ।


অতি !আনন্দে বাঁশুরি বাঁজায়ে চলেছে অর্ফিয়াস,
পিছনে পিছনে চলে ইউরিডিস মনে তাঁর উল্লাস।
নরকের শেষ সীমানায় এসে থামে তাঁরা দুজনায়,
নিষেধের কথা ভুলে গিয়ে সব পিছনের পানে চায়।
সহসা তাহার চোখের সামনে ইউরিডিস সুন্দরী,
শেষ মূহুর্তে হা-হা করে হেসে শূন্যেতে যায় উড়ি'।
বিদায়ের হাসি ম্লান ছিলো বড়ো, ছিলো যে আকুতিভরা,
অর্ফিয়াসও চেয়ে রয় শুধু, হৃদয় দুঃখঝরা।
হারাইয়া প্রিয়া বিরহী প্রেমিক পাগলের প্রায় ঘুরে,
বনে ও পাহাড়ে, গিরীর গুহায় খুঁজিয়া খুঁজিয়া মরে।


গাছের পাতায় নিশ্বাস ছেড়ে বলছে, 'ইউরিডিস'!
পাখিরা শাখায় করুণ সুরেতে ডাকছে, 'ইউরিডিস'!
বনের পশুরা সব কিছু ভুলে চাইছে, 'ইউরিডিস'!
নদী-সরোবর ঢেউয়ের শব্দে ডাকছে, 'ইউরিডিস'!
অস্থির মনে ঘুরিতেছে প্রেমী বিশ্ব-জগত-ধামে,
শূন্য বাঁশুরী ঝংকারি উঠে ইউরিডিসের নামে।
দুঃখমাখানো কতশত সুর, বেদনায় উড়ে উড়ে,
আকাশ পাতাল মন্থন করে অর্ফিয়াসের সুরে।


এহেন সময় মদ্য-দেবতা বাকাসের সঙ্গীরা,
বললো যে তাকে, ''বাজাও বাঁশুরী, দিলাম মাথার কিড়া।
নাচবো সবাই বাঁশুরীর তালে আনন্দ উৎসবে,
আনন্দ ছাড়া মানুষ জীবনে নেই কোন সুখ ভবে।
বাঁশির সুরের আনন্দতায় ভুলে যাবো সব দুখ;
মদ্য পানের অমল প্রভাবে আমরা যে উৎসুক''।
বাজে না বাঁশুরি, তোলে নাকো সুর কোন আনন্দতায়,
বিরহী-বেদন বিষাদের সুরে তোলপাড় করে যায়।
ক্ষিপ্ত হইয়া মদ্যদেবতা, সঙ্গীদলের সবে,
প্রহার করিলো অর্ফিয়াসকে ক্রোধোন্মত্য রবে।
হত্যা করিয়া দেহখানি তাঁর ফেলে দিল নদী-জলে,
আজো নদীজল বহে অবিরল ইউরিডিসের ছলে।


জলে ও স্থলে গাঙ্গের স্রোতে ঝরণার ঝরঝর-
'ও ইউরিডিস'! 'ও ইউরিডিস'!! ডাকিছে নিরন্তর।


১৯/১১/২০২৩
ঢাকা।