শ্রদ্বেয় কবি ড. শাহানারা মশিউর -এর কবিতা "লৌহ পাঁজর (ডিএনএ হেলিক্স)"-ছোট অথচ অর্থময়, শক্তিশালী কবিতা


- জাহিদ হোসেন রনজু।  


কবিতা - লৌহ পাঁজর (ডিএনএ হেলিক্স)
কবিঃ ড. শাহানারা মশিউর


"স্বপ্নে দেখা
            রাজপুত্র
                   আসবে ভেবে
                       কুসুম ফুটে!
                     সদ্য ফোটা
               গোলাপের
         ডাল ভেঙ্গে
     বীর সেজেছে।                      
  ভেঙ্গে দাও          
           লাল আসর,
                    বহুগামী ৷    
  বাসর                            
                       লৌহ পাঁজর।
                     তা না হলে
               বসন্ত বাতাসে
          সবকটা ফুল
  ঝরে যাবে!

--------------------

DNA single helix -এর অবকাঠামো দেখলাম। অনিন্দ্য সুন্দর।

এবার আসুন এ কবিতার 'জিনোম সিকোয়েন্স' উদঘাটন করার চেষ্টা করি (আগেই বলে রাখি সব চেষ্টাই কিন্তু সফল হয় না)ঃ

বৈজ্ঞানিক নামঃ লৌহ পাঁজর (ডিএনএ হেলিক্স)

আবিষ্কারকঃ ড. শাহানারা মশিউর

গোত্রঃ সাহিত্য

শ্রেণিঃ বাংলা গদ্য কবিতা

উদ্ভবঃ সমসাময়িক বৈশ্বিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে মনের তাড়না থেকে এর উদ্ভব।

বিবর্তনঃ মনের ভিতর বিদ্যমান সুকুমারবৃত্তির সাথে মানুষের অনৈতিক ক্রিয়ার ক্রমাগত সংঘাতে, মানসিক পীড়নে বিবর্তনের মাধ্যমে এই কবিতার সৃষ্টি।

পরিচয়ঃ সহজ, সরল অবয়বে মানুষের মননে অবক্ষয় ও পশু শক্তির বিরুদ্ধে সুনামীর মতন আঘাতে প্রচণ্ড অভিঘাত সৃষ্টিকারী কবিতা।

বৈশিষ্ট্যঃ এর প্রতিটি শব্দ, বাক্য অনন্য বৈশিষ্ট্যে দীপ্যমান। প্রথম বাক্যটি দেখি-

"স্বপ্নে দেখা
            রাজপুত্র
                   আসবে ভেবে
                       কুসুম ফুটে!"

এ বিশ্ব সংসারের প্রতিটি কিশোরীর মনের অলিন্দে যে স্বপ্নটি লুকায়িত থাকে, সেই চিরন্তন সত্য, সেই মধুরতম আকাঙ্ক্ষার কথা অল্প শব্দ চয়নে অপূর্ব সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। যা মনের শুভ্রতার, অকৃত্রিম ভালবাসার চিত্র অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

কবিতার দ্বিতীয় বাক্যটিতে এসে আমরা যা দেখতে পাই তা হলো বর্তমান সামাজিক অবক্ষয়ের কথা, সুকুমারবৃত্তিকে পদদলিত করার, পেশী শক্তির মাধ্যমে একটি সুন্দর মনোরম স্বপ্নকে তছনছ করার চিত্র।
                    " সদ্য ফোটা
               গোলাপের
         ডাল ভেঙ্গে
     বীর সেজেছে।"

এখানে সুন্দর বিনাশকারী ও বর্তমান মানসিক অবক্ষয়ের চিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুঁটে উঠেছে।

এই কবিতার যে বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে মূল্যবান, তাৎপর্যময় এবং অনন্য সেটি এই তৃতীয় বাক্যটিতে সূর্যের মতন জ্বলজ্বল করছে-

"  ভেঙ্গে দাও          
           লাল আসর,
                   বহুগামী
                          বাসর                            
                        লৌহ পাঁজর।"

মনের মকুরের নিষ্পাপ ভালবাসাকে পেশীশক্তির কাছে নিষ্পেষিত হতে দেখে, হাহাকারে আকাশ-বাতাস ভরিয়ে দিয়ে বসে থাকলে হবে না, এই বিশ্বকে সুন্দর রাখতে, মনের সুকুমারবৃত্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রতিবাদী হতে হবে, গুড়িয়ে দিতে হবে দর্পিত অশুভ মনোবৃত্তিকে, পশুত্বকে।
কী অপূর্ব সুন্দর উপস্থাপনায় মানুষের বর্তমান করনীয়টি ফুঁটে  উঠেছে এই কবিতার এই বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থে যা মনকে জেগে উঠার প্রেরণা জোগায়।

সর্বশেষ বাক্যটিতে আমরা যে সতর্কবার্তা দেখতে পাই, সেটি আমাদেরকে মধ্যযুগের, বর্বর যুগের ভয়াবহতার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা আতংকে  চমকে চমকে উঠি-

                     "তা না হলে
               বসন্ত বাতাসে
          সবকটা ফুল
  ঝরে যাবে!"

এই ভয় জাগানিয়া সতর্কবার্তা আমাদেরকে এই অশুভ, অকল্যাণকর পরিস্থিতি রুখতে, প্রতিরোধ করতে মনের গভীরে সুনামির মতন ঢেউ তুলে। বর্তমান বৈরী এবং প্রতিকূল পরিবেশটাকে পাল্টানোর মিছিলে সামিল হওয়ার প্রেরণা জাগায়।

শক্তিমান কবি ড. শাহানারা মশিউর এর কবিতা "লৌহ পাঁজর(ডিএনএ হেলিক্স)" -এর এই হলো 'জিনোম সিকোয়েন্স' বা জীবনরহস্য।

অত্যন্ত শক্তিশালী, সহজ, সরল কিন্তু আটলান্টিক মহাসাগরের মতন গভীর ভাবনার ও বোধের কবিতা এই "লৌহ পাঁজর(ডিএনএ হেলিক্স)"।

শ্রদ্বেয় কবি ড. শাহানারা মশিউর সবসময়ই সুন্দর, সকলের বোধগম্য ভাষায় কবিতা লিখে বাংলা কবিতা তথা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছেন। উনার এই প্রচেষ্টা দীর্ঘজীবী হোক।

সতত শ্রদ্ধা রইল।

ফুটনোটঃ আলোচনা দিয়ে নয়, কবিতা পড়ে এর মূল্যায়ন করলে আপনি জিতে যাবেন। কারণ আলোচনায় আমি দুর্বলতম জিনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।