শক্তিমান কবি ডঃ শাহানারা মশিউর-এর ''একমুঠো আগ্রহ" নিয়ে আমার অভিব্যক্তি
- জাহিদ হোসেন রনজু
--------------------------------------------
নারীমুক্তি নিয়ে, লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে, নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে এ যাবত কত আলোচনা হয়েছে, কত সেমিনার হয়েছে, হয়েছে কত বাদপ্রতিবাদ-সংগ্রাম।
কত পথ বাতলে দেয়া হয়েছে, কত পথের কথা বলা হয়েছে সে সব আলোচনা, সেমিনার, গবেষণায়। ডঃ শাহানারা মশিউর-এর "একমুঠো আগ্রহ" ছোট্ট কবিতাটিতে এসে সকল আলোচনা, সংগ্রাম এক হয়ে মিশে গেছে। কী নেই এই কবিতাটিতে। বলা যেতে পারে লিঙ্গ-বান্ধব পৃথিবী গড়ার মূল সুরটি, উত্তরণের জন্য করণীয়, প্রতিবন্ধকতা, শ্লেষ এবং সর্বোপরি মানবিক আহ্বান সকলই রয়েছে এই কবিতাটিতে।
প্রথমেই আসি কবিতার শিরোনামে- 'একমুঠো আগ্রহ'। আগ্রহের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে-
ঐকান্তিক চেষ্টা বা ইচ্ছা, ব্যগ্রতা, ঐকান্তিক যত্ন বা মনোযোগ ; অভিনিবেশ। অর্থাৎ ছোট একটি ঐকান্তিক ইচ্ছা, চেষ্টা ও যত্নই পারে পৃথিবীকে লিঙ্গ-বান্ধব করতে। কবিতার শিরোনামটি কবিতার মূলভাবটি চমৎকারভাবে বুকে ধারণ করে শুকতারার মতন দীপ্যমান। অত্যন্ত সার্থক শিরোনাম -'একমুঠো আগ্রহ" ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কার ইচ্ছে? কার আগ্রহ? কীসের আগ্রহ? সেই আগ্রহের সৃষ্টি হলে কী পাওয়া যাবে? কীভাবে পাওয়া যাবে?
'তোমাদের একমুঠো আগ্রহের বুকে
একটি স্বর্ণখনি আছে ।
অলংকার বানাও,
সাজাও একটি লিঙ্গ-বান্ধব পৃথিবীকে ।
নষ্ট নগর থেকে মুক্ত কর পতিতাদের
যুক্ত কর, সুন্দর কোন কাজে ।'
উপরের সকল প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে গেলেন তো কবিতার শুরুর এই স্তবকে। পাননি? পেয়েছেন নিশ্চয়ই। তবু বলছি। আসুন আমার সাথে স্তবকের শব্দ, বাক্যগুলোকে নেড়েচেড়ে দেখি-
'তোমাদের' বলতে কবি কাদের বুঝিয়েছেন?
উত্তরটা খুবই সহজ এবং পানির মতন পরিষ্কার- পুরুষদের বুঝিয়েছেন। জ্বী পুরুষদের। কারণ পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের দণ্ডমূল কর্তা হলেন পুরুষ। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই চলছে এই ধরিত্রী।
'একমুঠো আগ্রহের বুকে একটি স্বর্ণখনি আছে' - সত্যিই তো তাই। কর্তার ইচ্ছাই স্বর্ণখনি যদি সেখানে ঐকান্তিক সদিচ্ছার জন্ম হয়। এই পৃথিবীর অধিকর্তা পুরুষের বোধে যদি নারী-পুরুষের সমতার আগ্রহটা জন্ম নেয় তাহলেই প্রথম এবং প্রধান কাজটি সম্পন্ন হয়ে যাবে। কবি চমৎকারভাবে কবিতার প্রথম দুই চরণে সে কথাটি বলে দিয়েছেন।
ইচ্ছা তখনই ফলপ্রসূ হয় যখন তা কাজে রূপান্তরিত হয়। দেখুন কবি কী সুন্দরভাবে সেটি বলেছেন-
'অলংকার বানাও,
সাজাও একটি লিঙ্গ-বান্ধব পৃথিবীকে ।'
শুধু স্বর্ণের খনি থাকলেই হবে না, সেই স্বর্ণ দিয়ে অলংকার গড়তে হবে অর্থাৎ ইচ্ছে মনে ধারণ করে বসে থাকলে হবে না, সেই সদিচ্ছা দিয়ে কাজ করে যেতে হবে। তবেই না সমতাভিত্তিক পৃথিবী হয়ে উঠবে বাদ্ধব।
না এই কাজটির জন্য একা পুরুষ কর্তাই নয়, নারীকে পণ্য হওয়ার হাত থেকে মুক্ত করে তাকেও কাজে যুক্ত করতে হবে এই পৃথিবী গড়তে। কবির ভাষায়-
'নষ্ট নগর থেকে মুক্ত কর পতিতাদের
যুক্ত কর, সুন্দর কোন কাজে ।'
এখানেই শেষ হতে পারতো কবিতাটি। তা হয়নি। তা হয়নি কারণ কবি জানেন প্রতিবন্ধকতা আছে। আছে নানান রকম কুসংস্কারের বেড়াজালে বেধে এই মহৎ ইচ্ছের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মতন মানুষ। তবে কবি এখানে বিদ্রোহী। শ্লেষাত্মক বাক্য দিয়ে তিনি তাদের আঘাত করে বলে দিয়েছেন না এটা আর সম্ভব হবে না, এটা তাদের জন্য ভালও নয় শিখে নাও-
'পর্দার নামে নারীর পবিত্র দেহকে
যারা ভিজায় বিষাক্ত ঘামে-
তাঁদের নিজের নামটি শুদ্ধ করে লিখতে বলো ।
শিখতে বলো,
দিনের আলোয় ঘুমানো ভালো নয় !'
পরিশেষে শেষ স্তবকে দেখি কবি এই পৃথিবীকে লিঙ্গ-বান্ধব করার প্রয়োজনে কী করণীয় সেটাও খুব সুন্দর করে তুলে এনেছেন। এখানে কবি শান্ত, ধীর। ক্ষোভ-দুঃখ-আবেগে নয়, বিদ্রোহের অনলেও নয়, মানবিকতার আনন্দে শান্তভাবে বিপরীত মতাদর্শকে এক সূতায় বেধে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে নিয়ে যেতে বলেছেন। যেমন নদীর ঢেউ বিহীন স্রোতধারা শান্ত, ধীরভাবে এগিয়ে যায় তার কেন্দ্রের দিকে সাগর, মহাসাগরে-
"দুই প্রান্তের দুটি ভ্রান্ত বিশ্বাসকে
একটি শান্ত সুতোয় বেঁধে-
টানতে থাকো সঠিক কেন্দ্রের দিকে…"
ডঃ শাহানারা মশিউর একজন প্রগতিশীল মানবিক বোধসম্পন্ন শক্তিমান শ্রদ্ধেয় কবি। তিনি বরাবরই খুব ভাল লিখেন। এ কবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। অপূর্ব সুন্দর কবিতা, শক্তিশালী কবিতা।
আমার মতন অলেখকের হাতে এর আলোচনা তেমনভাবে প্রস্ফুটিত হয়নি, সেটা আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি এই আলোচনার পিছনে আমার সবটুকু ভাললাগা ছিলো। এরপরও যদি মনে হয় 'না লিখলেই ভাল হতো', তাহলে শেষ অস্ত্রটাই পেশ করে রাখছি- "ধৃষ্টতা মার্জনীয়"।
প্রিয় কবির প্রতি রইল অপার শ্রদ্ধা । কবি ভাল থাকুন সব সময় আপনার মতন করেই।