বাংলা কবিতা ডটকমঃ  নবীন কবির কবিতা, সমালোচনা

জাহিদ হোসেন রনজু


ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা , শরৎ , হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এ ছয় ঋতুর আবর্তন বাংলার প্রকৃতিকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে।
আর ঋতুচক্রের এই বৈচিত্র্যের ছোঁয়ায় মানুষের মনেও লাগে দোলা। তাই বাংলার মানুষের মনও জন্মগতভাবে, প্রাকৃতিক কারণেই হয়ে উঠে ভাবপ্রবন। ফলে যা হওয়ার তাই, দেখা যায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে কবির আধিক্য। আর এ ক্ষেত্রে প্রতি নিয়তই বাংলা সাহিত্যে নবীন কবি ঝাঁকে ঝাঁকে আসবেন এটাই তো স্বাভাবিক এবং এটা দোষের এমন ভাবাটা নিতান্ত অন্যায় হবে বলেই মনে হয়। বরং এটা একটি খুবই ইতিবাচক দিক।

এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়কে তুলে ধরছি -

তুরস্কের সব মসজিদেই লেখা থাকে

“নামাজ পড়ার সময় যদি পেছনের সারি থেকে বাচ্চাদের হাসির আওয়াজ না আসে, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের ব্যাপারে ভয় করুন।”

এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য নিন্মরূপঃ

বাচ্চারা হলো ফেরেস্তার মতো এরা এখানে আসবে একটু দুষ্টামি করবে।  কিন্তু দেখতে দেখতে ওরাও একদিন এটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। দুষ্টামির ব্যাপারটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। সেটা কোন ব্যাপার না।
কিন্তু এখন যদি ওকে মসজিদে এলে হুমকি দামকি দেওয়া হয়, মারা হয় তাহলে সে তো আর এইখানে আসতেই চাইবে না। একটা ভয় নিয়ে বেড়ে উঠবে। এটা তো ঠিক না।

কি সুন্দর যুক্তি।

এ রকম দৃষ্টিভঙ্গি কবিতার অঙ্গণের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য।
এই আসরের যারা বিজ্ঞজন আছেন তারা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন।

নবীন বা প্রবীণ কিংবা অজ্ঞ বা বিজ্ঞ কবি বলে কোন কথা নেই, সকল কবির ক্ষেত্রেই কবির নিজস্ব স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন।
'বাংলা সাহিত্য : কয়েকটি প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে মাহবুবুল হক ইংরেজ লেখক ই.এম. ফস্টারের একটি অভিমত উল্লেখ করেছেন,
‘অন্তত তিনটি কারণে লেখকের স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন:

প্রথমত, স্বাধীনতা ছাড়া লেখক কোনো কিছুর সৃষ্টির প্রেরণা পান না;

দ্বিতীয়ত, লেখক যা ভাবেন তা প্রকাশ করার স্বাধীনতা না থাকলে লেখকের সৃষ্টি সার্থক হয় না;

তৃতীয়ত, জনসাধারণের চেতনা ও মানস বিকাশের জন্যও এগুলি দরকার।’ 

তাই কবিকে তার স্বাধীনভাবে লিখতে দেয়া উচিত। মানে বিচারে উত্তীর্ণ হলো কী হলো না সেটা বিবেচনা করতে যেয়ে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া উচিত হবে না।

বলে রাখা জরুরি যে, প্রত্যেকটি কবিতা কবির নিজস্ব আলোয় আলো ছড়িয়ে থাকে। কোনো কবির দৃষ্টিভঙ্গি বা বোধের কাছাকাছি পৌঁছানো বেশ কঠিন। সুতরাং, কোনো কবিতাকে ‘কবিতা’ হয়নি দোহাই দিয়ে কবিতাকে নিচু করা আদৌ উচিত নয়।

একজন কবির কবিতা ভালো না মন্দ, আধুনিক না অনাধুনিক, মানসম্মত না মানহীন- এনিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে কবিদের মাঝেই এই বিতর্ক প্রবল। যিনি প্রচলিত ছন্দের কবিতায় অভ্যস্ত, তিনি এর বাইরের লেখা কবিতাকে 'ছন্দছুট' বলে খারিজ করে দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে কবিতা নিয়ে নিরীক্ষা করতে গিয়ে প্রচলিত ছন্দকাঠামোর বাইরে যে সকল সম্মানিত কবি কবিতা চর্চা করছেন, তারা ছন্দানুরাগী কবির কবিতাকে তথাকথিত 'কমনকবিতা' বলে খারিজ করে দিচ্ছেন।
আবার কবিতাকেন্দ্রিক অগ্রজ ও অনুজের মধ্যে বাকবিতণ্ডা তো লেগেই আছে হরদম। প্রবীণ কবি খেদ প্রকাশ করেন এই বলেন,

'নবীন কবিদের লেখা কিচ্ছু হয় না। সম্ভাবনা দেখছি না খুব একটা। এদের হাতে বাংলা কবিতার ভবিষ্যত অনুজ্জ্বল।'

এভাবেই প্রবীণ কবি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন নবীন কবির কবিতা। নবীন কবিদের কবিতা মূল্যায়ন করার মতো উদারতা তেমন দেখা যায় না।

সম্প্রতি আরও একটি ব্যাপার লক্ষণীয়, একজন কবির তুলনামূলক দুর্বল কোনো কবিতা কিংবা পঙক্তি নিয়ে হাসি তামাশা করতে দেখা যায়। যা মোটেও কাম্য নয়। কারণ, কবির সব পঙক্তি কালোত্তীর্ণ হবে এমনটি বলা যায় না। একটি কবিতা কিংবা পঙক্তির গ্রহণযোগ্যতায় একজন কবি শত শত বছর পাঠকের কাছে সমাদৃত হতে পারেন। কবি বেঁচে থাকেন মূলত তাঁর কাব্যবিন্যাসের স্বকীয়তায়। তাই উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে কোনো কবিকে হেয় করার মনোভঙ্গি নিয়ে তার অপেক্ষাকৃত দুর্বল লেখাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসা রীতিমতো অন্যায়।
সর্বোপরি কবিতা হচ্ছে শিল্পের প্রভাবিস্তারী শক্তিশালী মাধ্যম। আর তাই কবিতার নান্দনিক অনুভব ছুঁয়ে থাকুক একজন কবির মানসে।

অন্য দিকে এটাও দেখা যায় যে  কিছু প্রথিতযশা   সাহিত্যবোদ্ধারা নবীনদের উৎসাহিত করবার বদলে নিরুৎসাহিত করে চলেছেন। অথচ তাঁদের একটি উৎসাহ জীবন বদলে দিতে পারে একজন তরুণের। নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে কে-ই বা খারাপ শুনতে চায় ? একজন কবি কবিতা লিখেন না, জন্ম দেন। বিখ্যাত কবিদের কথাই ধরা যাক। তাঁদের কাছে কবিতা ছিলো অনেকটা প্রসববেদনার মতো। আমি মনে করি, নবীন / তরুণদের উৎসাহিত করা উচিত। তাঁদের কাঁধে চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক কবিতার 'সিলেবাস' চাপিয়ে না দিয়ে তাঁদের মতো করেই লিখতে উৎসাহিত করা উচিত। ভুল করতে করতে মানুষ শিখে। নবীন কবিরাও শিখবেন।

আরেকটি কথা বাংলা কবিতা ডটকম একটি কবিতার বিশাল প্লাটফর্ম। এখানে যদি কোন নবীন বা অখ্যাত কবি তার কবিতা পোস্ট করেন তাহলে যারা কবিতা লেখায় প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ এবং শ্রদ্ধাভাজন তাদের কবিতা পোস্ট দেয়ার জায়গার অভাব হয় বলে শুনিনি। তাহলে এত আক্ষেপ বা রাগ কেন হবে?
দেখুন বিশাল বনের মাঝে সুগন্ধ বিহীন 'বন্য' ফুল থাকে আবার সে বনেই থাকে সুগন্ধযুক্ত ফুলও । এর ফলে বনের কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না। বরং সুগন্ধি ফুলের সৌন্দর্য আরো বেশী প্রস্ফুটিত হয়। মানুষ তখন ফুল খুঁজতে গেলে বন্য ফুল দেখেই বুঝতে পারেন সুগন্ধি ফুলের সৌন্দর্যকে। তাই বন্য ফুলের আধিক্য দেখে শঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। বরং ফুল ফুঁটার সুযোগটা থাক প্রাকৃতিক নিয়ম মেনেই।  

একটি গল্প বলে শেষ করছি-

গল্পটি গোপাল ভাঁড়ের।

একদিন গোপাল ভাঁড়ের সাথে এক পণ্ডিত মহাশয়ের দেখা হলো। দেখা হওয়ার পর তাদের কথোপকথন-

গোপালঃ শুনেছি আপনি অনেক বড় জ্ঞানী জন। পণ্ডিত মানুষ।  আচ্ছা পণ্ডিতজি বলুন তো মানুষ কথা বলার সময় কখনো কখনো হাঁটাহাঁটি, খায় দায়,
নড়ে-চড়ে এ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে কেন?

পণ্ডিতঃ এসব ছোটলোক-ফোটলোকেরা বলে।

গোপালঃ পণ্ডিত মহাশয় আপনিতো উত্তর দেয়ার সাথে আপনার পরিচয়টাও দিয়ে দিলেন। আপনার পরিচয় কিন্তু আমি জানতে চাইনি।

অতএব সমালোচনাটাও করতে হবে সতর্কতার সাথে। নাহলে ঐ পণ্ডিতের মতন নিজের পরিচয়টাও বের হয়ে আসবে। উঠোন ঝাঁট দিতে হবে পরিষ্কার করার জন্য, রাগের বশে ঝাঁট দিয়ে ধূলোর ঝড়ে উঠোনসহ ঘর-বাড়ি ধূলোময় করার জন্য নয়।  ধনাত্মক বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে হবে, প্রয়োজনে শাসন করতে হবে, ভুল ধরিয়ে দিতে হবে।  সবাই মেনে নিবে। সুন্দর হয়ে উঠবে নবীন লেখকরাও। হয়তো সবাই নয় তবে নিশ্চিত  সুন্দর হয়ে উঠবেই অনেকে, অনেক কবি।

ঢালাওভাবে সমালোচনা না করে যদি নবীন কবিদের মান উন্নয়নের জন্য একান্ত ইচ্ছে থাকে তবে তার নির্দিষ্ট কবিতায় যেয়ে তার ভুলগুলো শুধরাতে হবে । সমালোচনাটা হতে হবে শিক্ষকের মমতায়, উদারতায়। বাংলা কবিতা ডটকম-এর কবিতার আসরে এমন বেশ কয়েকজন শ্রদ্বেয় কবি রয়েছেন। যাদের ভালবাসার পরশে বহু নবীন কবি তাদের লেখার মানকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছেন, করছেন।

(তথ্য সংগ্রহ এবং সহযোগিতাঃ ইন্টারনেট এবং
'বাংলা সাহিত্য : কয়েকটি প্রসঙ্গ’ -লেখক মাহবুবুল হক)