ইংরেজী "style" এবং "fashion" শব্দ দুটিকে প্রায়শই আমরা গুলিয়ে ফেলি। মুলত "style" বা "শৈলী " শব্দ দিয়ে কোন শিল্পির/ব্যাক্তির সুনির্দিষ্ট একক অথবা বহুমুখী প্রকাশ ভংগীকে বুঝানো হয়। অন্যদিকে "fashion" শব্দটি কোন বিশেষ সময়ের বিশেষ প্রকাশ ভংগীমাকে ইংগিত করে। সময়ের পরিক্রমায় ব্যক্তির "style" কিছু পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে আরো স্বকিয় এবং পরিনত রূপ লাভ করে। অপর পক্ষে কালের ধারায় নানামুখী প্রভাবক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে "fashion" এর আমুল পরিবর্তন হতে পারে।

সাহিত্য বা লেখালেখির জগতে  শৈলী বিজ্ঞানের গুরুত্ব রয়েছে। ইংরেজী " stylistics " শব্দের বাংলা "শৈলী বিজ্ঞান"। অথবা একে "রীতি বিজ্ঞান"ও বলা যায়।কোনাে লেখকের লিখন শৈলীর ভাষাবিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণকেই শৈলীবিজ্ঞান (Stylistics) বলা হয়।

শৈলীকে প্রথাগতভাবে দু-ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে一 (১) মূল্যায়নভিত্তিক (Evaluative) শৈলী এবং (২) বর্ণনামূলক (Descriptive) শৈলী। কোনাে রচনার শৈলীর বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রকাশই হল মূল্যায়নভিত্তিক শৈলী। আর, কোনাে লেখকের লেখার শৈলীর বিবরণই হল বর্ণনামূলক শৈলী। প্রথম প্রকারের শৈলীতে দুজন লেখকের শৈলীর পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কোনাে লেখকের দুটি পৃথক, একজাতীয় রচনার শৈলীর পার্থক্যের বিবরণ দেওয়া যায়।

ভাষা এবং সাহিত্য বিজ্ঞানে শৈলী নিয়ে বহু বহু তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। বিতর্ক আছে। এই আলোচনাকে সেদিকে টেনে নিতে চাই না। আমি শুধু খুব সংক্ষেপে একজন লেখক বা কবির জন্য এর ব্যবহারিক দিকটার দিকেই আলোকপাত করবো।

রবীন্দ্র সংগীত অথবা নজরুল সংগীত বলতে কোন একটি একক গানকে বোঝানো হয় কি? নিশ্চয় নয়। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে কবি রবীন্দ্রনাথ ও কবি নজরুল দুজনেই একটা নির্দিষ্ট রচনা শৈলী নির্মাণ করতে পেরেছিলেন যা খুব সহজেই আলাদা স্বাতন্ত্র দেয়। এমনকি
সেই সৃজনের মধ্যে বিষয় কথা এবং সুরের পার্থক্য সত্বেও কোথাও একটা বৃহৎ ঐক্যিতান সন্নিবেশিত আছে যা তাদের আলাদা ভাবে চিহ্নিত করে। আধুনিক লেখক হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পিছনেও রয়েছে নিজস্ব এক রচনা শৈলী। তিনি তার পূর্ববর্তী লেখকদের গাম্ভির্যপূর্ন বাহুল্য অলংকার আর শব্দের ভারী ভাষা বাদ দিয়ে সহজ সরল ভাষাকে বেছে নিয়ে ছিলেন। যদিও তিনি মানবিক আবেগ এবং মানব চরিত্রের বিচিত্র দিক গুলিকে নাটকিয় ভাবে উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের অপরিহার্য অন্য দিকগুলি পুষিয়ে দিয়ে ছিলেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়লেও বোঝা যায় তিনি অতি সতর্কভাবে এবং নিবেদিতভাবে তার পূর্ববর্তীদের রচনা রীতির প্রভাব বলয় কাটিয়ে উঠেছেন।এক্ষেত্রে তিনি ছন্দের ব্যবহারে এক অনন্য রীতির প্রচলন করেন। তাছাড়া তার শব্দ চয়নেও নিজস্ব সচেতন শৈলী চোখে পড়ে।

প্রশ্ন হচ্ছে এই নিজস্ব শৈলী কিভাবে তৈরী করতে হবে। আমি মনে করি প্রথমত আমাদের সর্বাগ্রে পূর্ববর্তীদের রচনা ভাল করে পড়তে হবে। পুং্খানুপুণ্খ ভাবে জানতে হবে কবিতা লেখার ব্যকরণগত দিক। ঐতিহ্য ইতিহাস এবং সাহিত্যের প্রধানতম মুভমেন্টগুলোকে ভাল করে জানার পর ধীরে ধীরে সচেতন ভাবে সেই প্রভাব বলয় কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা নিতে হবে।
নিজের শব্দ চয়ন, ভাষার ব্যবহার, ছন্দের ব্যবহার ভাব বা বিষয় নির্বাচনেও আনতে হবে
পরিবর্তন। তবে এই পরিবর্তন হতে হবে অবশ্যই নিজস্ব জন্মগত ও পরিবেশগত ভাবে প্রাপ্য ব্যাক্তিতের সাথে মানানসই কিছু।


যাই হোক উপরোক্ত আলোচনায় যা বলতে চেয়েছি তা হলো একজন সফল কবি বা লেখক হতে হলে নিজস্ব একটা রচনা রীতি তৈরী করতে হবে। নিজস্ব শৈলী তৈরীতে ব্যর্থ হলে এতো হাজার হাজার কবি লেখকের লক্ষ লক্ষ রচনার ভিঁড়ে আপনার আমার এই সব লেখা একদিন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
নিজস্ব রচনা শৈলী তৈরীতে সক্ষমরাই টিকে থাকবে।