দিনটা ছিল 1997 সালের 25-শে আগস্ট। সেদিন চারিদিকে পালিত হচ্ছে জন্মাষ্টমী অথ্যাত্ (হিন্দুধর্মে ভগবান) শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন। বিকেলে আমার পরমপুজ্জনীয়া মা আমাকে ভূমিষ্ঠ করলেন। সেই সময় চারিদিকে প্রচন্ড ঝর ও হাওয়া। আমি পৃথিবীতে আসলাম।
আমি একজন কৃষক পরিবারের সন্তান।সআমার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার ডোহাগুড়ি নামক গ্রামে। যা বর্তমানে শিলিগুড়ি থেকে 45 কিলোমিটার পশ্চিমে খরিবাড়ি অঞ্চলে। আমার মা লিপিকা সিংহ এবং বাবা বিমল কুমার সিংহ।
এরপরের দিনগুলি ভালই কাটে। সবকিছু মনে নেই। সারে তিন বছরে আমাকে ভর্তি করানো হল শিশুশিক্ষা কল্যাণ আশ্রমে। ভালই পড়াশুনা চলছিল। স্কুলটা আমার বাড়ির এক কিলোমিটারের কাছাকাছি-- এখনো আছে। স্কুলে শিক্ষকদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে পারতাম না। চুপচাপ শুনে যেতাম কী পড়াচ্ছে কী শোনাচ্ছে। আর বাড়িতে বাবার কাছে যা মার খেয়েছিলাম-- লাঠি দিয়ে, তির দিয়ে পড়াশুনায়। স্কুলে ছিলাম খুব দুষ্টু-- অন্যদের বই, পেনসিল, রবার, খাতা চুরি করতাম। প্রার্থনা কক্ষে প্রার্থনা করতে করতে উপরের দিকে থুথু ফেলতাম। স্কুলে প্যান্টে বেশ কয়েকবার পায়খানাও করে দিয়েছিলাম কারণ আমাকে খুব লজ্জা করতো পায়খানা যাবার। সেখানে স্কুলের মাঠের কোণে কয়েকটে সেগুন গাছ ছিল, সেই খোলা জায়গায় পায়খানা করতে হত। ছোট্ট ছিলাম তো কি হবে, আমার কি লজ্জা করত!
আমি খেলায় ছিলাম অপটু। একবারো পুরস্কার জিততে পারিনি। শুধু স্কুলের শেষের বছরে চতুর্থ শ্রেণীতে লংজাম্পে 12.50 ফুট লাফিয়ে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম। এর আগে পারিনি কারণ, একটুকুও ইচ্ছা ছিল না খেলায়। 100 মিটার রান খেলায় সবার থেকে শেষে থাকতাম আমি আর আমার বন্ধু জয়প্রকাশ। গুরুত্ব না থাকলেও যখন পুরস্কার দেওয়া হত তখন মনে হত, ইস! আমি'ও যদি পেতাম।
তারপর এই স্কুলে পাঁচটা বছর কাটল। শেষমেষ ভর্তি হলাম খরিবাড়ী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (উঃমা)-তে পঞ্চম শ্রেণীতে। সে কি পড়ার আনন্দ! নতুন নতুন বই, নতুন স্কুল। সত্যি কত আনন্দ ছিল সে জীবন। বেশ ভালো রেসাল্ট করতাম 60-70%। ধীরে ধীরে আমার ক্লাসের মেধাবীদের টপকে দিলাম সপ্তম শ্রেণীতে।
জীবনের হাসিখুশি মূল্যবান সময় সেই ছোট্টবেলা, বয়সের সাথে জীবন বেকার হয়ে পড়ে-- কত অভগা কর্তব্য নেমে আসে।
এই অষ্টম শ্রেণী অতিক্রম করছি। ধীরে ধীরে কিছু স্বামী বিবেকানন্দের বাণী কানে আঘাত করছে। তবুও অতটা গুরুত্ব নাই। যখন নবম শ্রেণীতে উঠলাম তখন ভেসে আসল চোখের সামনে হাজার হাজার দুঃখ, কিভাবে মানুষ মানুষকে লাঞ্চিত করছে, কিভাবে মানুষ মানুষের অজ্ঞানতার সুযোগ নিচ্ছে...
ছোট থেকে ছিলাম দুদার্ন্ত। অনেক নৈতিক শিক্ষা পেয়েছিলাম পূর্বের স্কুল থেকে। কিসের হিন্দু, কিসের মুসলমান? আমি কোনদিনো পার্থক্য বুঝিনি। শুধু পড়েছি, 'এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান মোরা ভাই ভাই।' তাই গর্জে উঠলাম আমি কি এসব, কিসের পার্থক্য?
তারপর নবম শ্রেণী। আমার মনকে বারবার ভাবিয়ে তুলছে যে, আমাদের পাঠ্যবই যা করতে শিক্ষা দেয়, সমাজ করে তার বিপরীত। আমি বুঝলাম এসব কুসংস্কার। এসময় কিছু কিছু বিবেকানন্দের বাণী স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম। আবার গর্জে উঠলাম। এভাবে বিবেকানন্দকে অনুসরণ করতে করতে বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব পেলাম। মন কাঁপিয়ে উঠল 'এই বিবেকানন্দটি কে?' তারপর দুঃখিত হলাম কত অর্ধভুক্ত-অনাথ শিশুদের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখে। ভাবলাম এদের সাহায্য করতে হবে। তারপর নবম শ্রেণীর শেষের দিকে আমি যোগের সংস্পর্শে এলাম-- ধ্যান, শরীরচর্চা শুরু হল।
সমাজ কল্যাণ করার জন্যে দশম শ্রেণীর মাঝামাঝি সময়ে একদিন হঠাত্ একটি টিম গঠন হল 'টিম হাঙ্গামা'। এবার সামাজিক কাজকর্ম শুরু হবে। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম আমার বন্ধুরা ধর্মনিরপেক্ষ হবে কিন্তু, না, তাদের মধ্যেও কুসংস্কারের বিজ লুকিয়ে আছে। আমি এবার আরও গর্জে উঠলাম এবং নেমে পড়লাম জীবনে হিন্দু-মুসলমান-ক্রিস্টান-বৌদ্ধ... পার্থক্য আর মিলন খুঁজতে। শুরু করলাম ধর্মপাঠ, কঠোর ধ্যান, প্রবল বিচার। আর স্বামী বিবেকানন্দের জীবনিকে নিলাম আমার জীবনের আদর্শরুপে, তাকে ভালোবেসে ফেললাম এমনভাবে যেন তার রক্ত আমার রক্তকণার মধ্যে বইছে। চলল তিন বছর কঠোর জীবন যাপন। শারিরীক, মানসিক ভাবে প্রায় ভেঙে পড়লাম। কখনো মৃত্যু হতে হতে বেঁচে গেছি। শেষমেষ খুঁজে পেলাম একমাত্র পরমেশ্বরকে, প্রেমের পরমেশ্বরকে। কোন ধর্ম নয় কোন জাতি নয় শুধু ভালোবাসা। শেষমেষ এটাই উপলব্ধি করলাম 'জীবে প্রেম করে যে জন সে দিন সে বিছে ইশ্বর।' ধীরে ধীরে কবিতার ভাব জেগে উঠল কবিতা লিখতে শুরু করলাম। কিন্তু এই জীবনে কোথাও শান্তি খুঁজে পাইনি, সমাজে শুধু হাহাকার, পারস্পরিক হিংসা-লোভ, মিথ্যা উদ্ভাবন, ঝগরা।
ভাবলাম, এবার মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হতে হবে, জীবনকে খুঁজতে হবে, মানুষকে ভালোবাসতে হবে, তাঁদের দুঃখ দূর করতে হবে...
আজ আমি খড়িবাড়ী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ছি, বয়স 17 বছর। জীবনের খোঁজ এখনো শেষ হয়নি, করতে আছি।আনুষ্ঠানিক সন্ন্যাস গ্রহণ'ও করিনি। আমার এই সন্ধান চলতে থাকবে যতদিন জীবন আছে। আসলে, জীবনকে জানতে না পারলে সে জীবন সার্থক হয় না। চেষ্টা করছি 'টিম হাঙ্গামাকে' এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
আমার আত্মজীবনি এখানেই শেষ। আমি যতদিন আছি স্বামী বিবেকানন্দ আমার অন্তরে আছে। সেই আমার ভালোবাসা, সেই আমার প্রাণ, সেই আমার ভগবান।
জয় জয় গুরুদেব।