পারমিতা,
হঠাৎ সেদিন বাসে তোমার সাথে দেখা হোল। আচমকা এই ছোট্ট সাক্ষ্যাত সৃতিচারনের পক্ষে যে খুবই উপযুক্ত তা নিয়ে আমার মধ্যে কোনও সন্দেহই ছিল না। হোলও তাই। তুমি বাস থেকে নেমে যাওয়ার পরেও বহুদূর তোমার পিছু নিয়েছিল আমার দৃষ্টি। আমি তখনও তোমার চোখের পাতার আসীন, যা কিনা এক মুহুর্তে আমার থেকে জানালার ভাঙা কাঁচটার ওপর শায়িত হল। তোমায় দেখে একটু অস্বস্তিতে পরে গিয়েছিলাম ঠিকই। 'শহর থেকে এত দূরে হঠাৎ'...
হঠাৎ এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খেয়েছিল মন জুড়ে। প্রাণ জুড়ে তখন শুধুই হাহাকার। তোমায় প্রশ্নটা করার আগেই তুমি নেমে গিয়েছিলে বাস থেকে। তখন তোমাকে কিছুই বলা হয়নি আর এখন চাইলেও বলতে পারব না। এইত কিছুদিন আগেও তোমার আর আমার মনের মধ্যে অতিত আর বর্তমানের একটা চরম বিভেদ প্রকাশ পেয়েছিল। এক মুহূর্তে জীবনের সব রঙ ছাপা হয়েছিল সৃতির আস্তাকুরে। তুমি হয়ত আজ আবার নতুন শুরে গান ধরেছো জীবনে। হয়ত তোমার সামনে খুলেছে সহস্র দরজাও। পারমানবিক বোমার বিধ্বংসী চরিত্রও হয়ত স্খলন করতে পারেনি তোমার যাত্রাপথ। ভালবাসার ওপরেও যে চেতনা কাজ করে তার প্রতিটি পদক্ষেপ যখন আস্তে আস্তে আমাদের দিনগুলোকে গিলে খাচ্ছে তখনই হঠাৎ উলটো পথ ধরল আমাদের সম্পর্ক।
আন্দোলনের দিনগুলোতে তোমার স্নিগ্ধ ঘামের গন্ধ মুগ্ধ করেছিলো আমায়। আজও ওই চেয়ারের হাতলে লেগে রয়েছে তোমার স্পর্শের তারল্য। তোমার শরীরে বিদেশি গন্ধ আজও বর্তমান। তবে আজ যখন আমার দরজায় তোমায় দেখি তখন নিজের অজান্তেই সব বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে চোখ চলে গিয়েছিলো তোমার সিঁথির দিকে। আমাদের মতাদর্শের ভিন্ন যুক্তিবাদী তোমার বাবা যেদিন আমায় বেরিয়ে যেতে বললেন, সেদিন তোমার চোখের সেই শুষ্ক বলিরেখা আমায় সস্তি দেয়নি মোটেই। বিশ্বাস কর পারমিতা, আজও তোমার সিঁথির ধু ধু আলপথ আমায় সস্তি দেয়নি। কারন এতো হওয়ার কথা ছিল না। অবশ্য তোমায় কিছু জিগ্যেস করার আগেই মুখ ফিরিয়ে নিলে তুমি। যে রাস্তা দিয়ে পুরনো চৌকাঠ খুজে পেয়েছিলে ফিরলে সেই রাস্তা ধরেই অতি সন্তর্পণে। সেই রাস্তার এক প্রান্তে আমার দির্ঘস্বাস তখন অনবরত চিৎকার করে চলেছে। গলা ফাটিয়ে জানতে চাইছে কেন? কেন তুমি কিছু না বলেই ফিরে গেলে? কেনই বা এসেছিলে আবার এতো বছর এতোটা পথ পার করে। যা কিনা সামাজিক ও আর্থিক দায়ভারে পরিপুষ্ট। নাকি আবারও নিস্থুরতা ফিরিয়ে দিতে এলে। এসে জানালে যে তুমি কত সুখে শান্তিতে রঙের খেলা খেলেছ এতো দিন ধরে। আবার আমাকে সেই মোরেই ছেড়ে এলে যেখানে আমি তোমাকে ছেরেছিলাম পাঁচ বছর আগে। একেই বোধহয় বলে মধুর প্রতিশোধ।
আমি জানি দুর্বার আয়ালা যেমন বয়ে গিয়েছিলো বঙ্গদেশের ওপর দিয়ে কিছু দিন আগে, ঠিক তেমনই বয়ে গিয়েছিলো আমাদের মধ্যেও। হঠাৎ কাউকে না জানিয়ে একটা দমকা হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে গেল পুরনো খবরগুলো। নাঃ বস্তা পচা সিনেমার মত বিয়ে তুমি করোনি কোনও বিলেত ফেরত ডাক্তার বা উকিলকে। আমাদের সম্পর্কে আহ্বান করোনি তৃতীয় ব্যাক্তিকে। তুমি সত্যি ভালবেশেছিলে আমাকে। সত্যি?........
পারমিতা, সময়ের সাথে সাথে আমাদের দেশ ও সংসার রঙ বদলেছে অনেকখানি। হয়তো সেই ভাবেই লাল থেকে সবুজ হয়ে উঠেছ তুমি। ডানা মেলেছ নীলচে আকাশের ঈশান কোনে। কিন্তু কেন যানিনা, আজও সময় হারিয়ে যায় সেই রাঙা মাসির চায়ের দোকানে। নতুন দিক খোঁজার চেষ্টা করে সেই এক টুকরো বেরঙিন পেয়ালায়। আমাদের চায়ের ঠেকের উল্টোদিকে যে ক্যান্সার হস্পিটাল রয়েছে, তাঁর বিকৃত হাসি আজও ধাক্কা দেয় আমাকে। শুধু ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে জীবনের আলপথ ধরে। টিক... টিক... টিক। কিন্তু আমার যে আর সময় নেই।।
শুধু একটা শেষ কথা বলতে চাই তোমায়। আমায় তুমি বিয়ে করনি, ভালই করেছ। একজন মুমুর্শের পাণিপ্রার্থী হয়ে চলটা ওঠা দেওয়ালে কবিগুরুর ছবি খুঁজে বের করার চেয়ে, ঠান্ডা মাটির ঘ্রানে ভরা শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব পালন করা অনেকবেশি বিবেচ্য। তবু বল পারমিতা আজ এই মুহুর্তে, একটিবারের জন্যও কি... নাহ থাক সে বিষয়। তোমার মনের কথা আমি ভালভাবেই জানি। আর জানি বলেই এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি তোমার বাবার দেওয়া মিথ্যে অহংকারের মুখোশটা আরও একবার হার মানল তোমার চোখের কাছে। আর তাতেই মুক্তি পেলাম আমি... ভালো থেকো।।