যেদিন থেকে কুষ্টিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা পাকাপাকি ভাবে ঠিক হয়েছিল সেদিন থেকেই একটা দারুন রোমাঞ্চ তৈরী হয়েছিল মনের মধ্যে । পদ্মা নদী পাড়ি দেওয়ার স্বপ্নটা এবারে সত্যি হবে । যে লালন শাহের গান শোনে শোনে বড় হয়েছে, যে লালনগীতি আমাকে বার বার ভাবায়, যে লালনগীতি যেন আমার শিরা উপ-শিরায় বাহিত হয়, সেই লালনগীতির স্রষ্টা লালন শাহের বাড়ি আমি ছুঁয়ে দেখবো, আমি দেখবো তার প্রতিদিনের যাপিত জীবনের ইতিবৃত্ত, ভাবতেই একটা ভালো লাগার পরশ লাগে গায় । এভাবেই ভাবতে ভাবতে বাংলা কবিতা ডট কমের কবি সম্মেলনের মূল পর্ব শেষ করে তারও একদিন পরে অর্থাৎ ২৫ শে ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ইং মূলতঃ প্রিয় কবি দিদি আফ্রিনা নাজনীন মিলি ও কবি দাদা জাহেদ হাসান রঞ্জু দাদার তত্তাবধানে বিকেল ৩ টায় গাবতলী বাসষ্ট্যান্ড থেকে রওনা দেই কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে । আমরা মানে ভারতীয় টিম যদিও নিজেদের গড়িমসির কারণে একটু দেরী করে ফেলেছিলাম এবং মিলিদির বাড়ি থেকে গাবতলী যাওয়ার রাস্তায় ট্রাফিক জামের অনবিজ্ঞতার কারণে আমাদের জন্য আস্ত বাসকেই দাড় করিয়ে রেখেছিলেন স্ট্যান্ডে । দৌড়ে গিয়ে উঠে দেখি আমাদের সঙ্গে সঙ্গী হিসাবে আগে থেকেই বাসে বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিলেন কবি হুমায়ূন কবীর, কবি মোজাম্মেল হোসেন এছাড়াও একেবারে যথোপযুক্ত অবিভাবক তথা মিলিদির খুব কাছের বন্ধু এডভোকেট মোঃ সাজ্জাদ হোসেন ও উনার সহধর্মীনি । যদিও আমাদের শ্রদ্ধেয়া কবি সেলিনা খাতুন আমাদের সঙ্গেই যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু শেষ মূহুর্তে যাওয়া হয়নি । মিলি’দি কিন্তু আমাদের সঙ্গে বাসে উঠেনি কেননা তখনো উনার কন্যার চাকুরী বিষয়ক একটি পরীক্ষা চলছিল সাভারে । শেষ পর্যন্ত সাভার থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন দিদি । যদিও বাসে অন্য আরোও অনেক যাত্রী ছিল কিন্তু মিলি’দি বাসে উঠার পর থেকে মনে হচ্ছিল গোটা বাসটা যেন আমাদের জন্যই রিজার্ভ । আরোও জানতে পারলাম এই বাসের নির্দিষ্ট সময় ছিল সকাল বেলা কিন্ত মিলি’দির অসুবিধার কারণে সাজু ভাই এর কল্যাণে বাসের সময় পরিবর্তন করা হয়েছে । সবচাইতে বড় হাসির এবং আশ্চর্যের বিষয় হল আমরা জানি না বলে আমাদের প্রত্যেকের লাগেজে যদিও যথেষ্ট শীত বস্ত্র ছিল কিন্তু কেউ সঙ্গে নিই নি, আস্ত লাগেজ আমরা মিলি’দির বাড়িতেই রেখে এসেছি । ভালো – মন্দ, সুবিধা-অসুবিধার সীট নিয়ে হৈ হুল্লুর করতে করতে পদ্মা নদীর কাছাকাছি আসাতে যখন গায়ে ঠান্ডা বাতাস লাগলো, তখন গিয়ে আমাদের চৈতণ্য হলো , ‘এবারে কি করা !’ কেউ নিলো রণজু ভাইয়ের জ্যাকেট , কেউ গামছা আর আমিতো মিলি’দির চাঁদর দখল করে বসলাম । এখানে আতীথেয়তা আর ত্যাগ নিয়ে লিখলে আরো অনেক কিছু লিখা যায় কিন্তু আপনাদের ধৈর্য থাকবে না তাই একটু সংক্ষেপ করলাম এবং ইতিমধ্যে আমরা পদ্মানদীর তীরে চলে আসলাম । উদ্যোক্তাগন জানালেন , আমাদের দেখানোর জন্যই যাওয়ার পথে আমরা ফেরীতে পদ্মা পাড় হবো আর আসার পথে পদ্মাসেতু দেখে আসবো । ফেরী’র কথা শোনেই আমাদের আরেকদফা উৎসাহ উদ্দীপনা বেড়ে গেলো । ফেরী কি, কেন,কিভাবে যায়, কি থাকে, কবে থেকে ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম ফেরীর তিন তলায় যেখানে যাত্রীদের সুন্দর বসা এবং পরিদর্শনের ব্যবস্থাও আছে , আছে ঝাল মুড়ি সহ বিভিন্ন রকম খাবারের বিক্রেতার সমারোহ । এখানে বলে রাখি, পদ্মার ইলিশ মাছও কিন্তু বিক্রি হচ্ছিল, বাড়ি আসার পথে হলে নিশ্চয়ই কিনে নিয়ে আসতাম । সেই সঙ্গে শুরুতেই বলে রাখি, আমাদের চিরচেনা বিজ্ঞ এবং গম্ভীর কবি রঞ্জু ভাই এবং বিশেষ করে মিলি আপা একেবারেই চেন এক অচেনা খোলামেলা হৃদয়ের মানুষ হয়ে ধরা দিলেন । হাসি ঠাট্টায়, হৈ-হুল্লুরে একেবারে চরম আড্ডার আনন্দ ঊপভোগ যাকে বলে সেটাই পেয়েছি, আর পেয়েছি বলেই অনুষ্ঠানের এত দিন পরেও জীবন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করেও ভুলতে পারছি না এক একটা মুহুর্ত ।
এভাবেই পদ্মা পেড়িয়ে, আরোও অনেক পথের গল্প পাশে রেখে রাত প্রায় পৌণে ন’টায় আমরা গিয়ে নামলাম জিলিপি মোড়ে । সেখান থেকে আমাদের থাকার গন্তব্যে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম বা ব্যবস্থা হচ্ছে ভ্যান রিক্সা অর্থাৎ আমাদের এখানে যে রিক্সা গুলো সাধারণত মাল পরিবহন করে সেইগুলোকে আরেকটু মোডিফাইড করে ওখানে যাত্রী পরিবহন করা হয়, একেই বলে “এক দেশের গালি তো আরেক দেশের বুলি” । এ নিয়েও কম চাপাবাজি বা ঢপবাজি হয়নি !!! হুমায়ূন কবির ভাই এই রিক্সার নাম দিলেন বোয়িং ৭৯, আমরা এর পর থেকে এগুলোকে বোয়িং বলেই ডেকেছি । রাত আনুমানিক দশটা নাগাদ আমরা গিয়ে পৌছলাম আমাদের গন্তব্যস্থল ,“ হাজী কিয়ামত আলী বিশ্বাস গেদিরননেছা বালিকা এতিম খানা” কুমারখালী, কুষ্টিয়া । এত রাতে পৌছেও সেখানে যে আতিথেয়তা , আপ্যায়নের উষ্ণতাকে পরশ করেছি, তাতেই আগামী দুদিন আমাদের জন্য এই কুষ্টিয়া ভ্রমণ আরোও কি চমক নিয়ে আসবে টের পেয়ে গেছি । এই এতিমখানার ইতিবৃত্ত সহ কুষ্টিয়ার দর্শনীয় স্থান এবং স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপনের অপুর্ব সব অভিজ্ঞতা যদি এই পর্বে লিখতে যাই তবে এত বড় লেখা হবে যে আপনাদের ধৈর্য হারানোর ভয় পাচ্ছি, তাই আগামী দিনে রোমাঞ্চে ভরা আরো দুই দিনের অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করার ইচ্ছা রেখে এখানেই আজকে ইতি টানলাম ।