জাগো অর্জুন
✍-উজ্জ্বল সরদার আর্য
(তৃতীয় সর্গ)
হে পার্থ, তাই হইও না অতিশয় আসক্ত
পরমাত্মায় করো বুদ্ধি স্থির,
নিজেকে চেন আগে রণক্ষেত্র মার্গে
হয়ে ওঠো বীর-
মিথ্যা বন্ধন থেকে নাও মুক্তি!
ফলের আশা নয় কর্মে করো জয়
অন্তরে সন্ধান করো শক্তি।
‘‘পরমাত্মায় রেখে নিজ বুদ্ধি
হতে চাই শুদ্ধি,
শুধু কর্মযোগী হওয়ার মার্গ দেখান!
হে পার্থ, সাংখ্য যোগের কারণে
নিরন্তর-নির্জনে,
পরমাত্মা স্মরণে হয় বলবান।’’
আর পরমাত্মা কে স্মরণ করার ফলে
অন্তর-অন্তস্তলে
সমর্পণের ভাব হয় উৎপন্ন,
আর এই ভাবকে ভক্তি বলে
ভক্তি থেকে জ্ঞান মেলে
জ্ঞান'ই অমর-অনন্য।
জ্ঞান থেকে হয় পরমাত্মা দর্শন
অর্জুন হও তুমি সমর্পণ
তবে'ই হতে পারবে কর্মযোগী!
পরমাত্মা দর্শনে জাগো এই ক্ষণে
মায়ায় শৃঙ্খল ছিঁড়ে কাঁপাও শৃঙ্গী-
করো মোক্ষ লাভ;
ঈশ্বর দেখা পেলে তবেই মুক্তি মেলে
এটি ধর্মের অন্তিম ধাপ।
‘‘কিন্তু আমি এই ক্ষণ, কি করে হবো সমর্পণ,
পরমাত্মা দর্শন ব্যতীত?
হে মাধব, দেখাও আমায় মুক্তির পথ
অজ্ঞানে আমি উন্মাদ,
হয়ে আছে অন্তর পীড়িত-ভারাক্রান্ত।’’
পরমাত্মা দর্শন হেতু খোলো চক্ষু
জাগাও অন্তর,
ক্রোধ-কামনা-লালসা-অহংকার -
সরিয়ে ফেলো;
তবেই তারে পাবে খুঁজে বিশ্ব মাঝে
আঁধারে ধর্মের প্রদীপ জ্বালো।
অন্ধকার গ্রহে উপবিষ্ট মানুষ যদি বলে
সূর্য দর্শন করবো সুকৌশলে,
তবে তাকে কি বলবে?
কক্ষ থেকে এসো বাইরে
এসো মুক্ত আকাশের তরে
সূর্য সদা-সর্বদা জ্বলছে, জ্বলবে।
ঠিক সে রকম এই সৃষ্টি'ই পরমাত্মা-
পরমাত্মা ব্যতীত কিছু নেই,
যে নিজ আত্মাকে দর্শন করে ফেলে
সেই বলে পরমাত্মা এখানেই।
যে রূপ লবণের একটি কোণার স্বাদ
সমগ্র সাগরের স্বাদ থেকে ভিন্ন নয়,
ঠিক সেরূপ নিজের আত্ম দর্শন
পরমাত্মা দর্শন হয়।
‘‘অর্থাৎ আপনিও কি পরমাত্মা
হে মাধব?
হ্যাঁ পার্থ, তুমিও যেরূপ -
সেরূপ পরমাত্মা!
শুধু জেনেছি আমি,জাগ্রত নও তুমি-
আজ আমার মাঝে খোঁজো বিধাতা।’’
‘‘তাহলে আপনার প্রতি সমর্পণ
ঈশ্বরের প্রতি কেন নয়?
এ কথা কে বলেছে তোমায়?
অবশ্যই আমার প্রতি সমর্পণ
ঈশ্বর দর্শন,
সব কিছু ত্যাগ করে খোঁজো আমায়।’’
আমিই সংসার, শ্রেষ্ঠ সবার-
সংসারের প্রতিটি কণা!
আমি সূর্য, চন্দ্র,নক্ষত্র, গ্রহ রাজি সমস্ত,
ভুলে যাও হে পার্থ সকল মায়া-মোহ বেদনা।
আমি সূর্য অপেক্ষা অধিক
পুরাতন,
আর বৃক্ষে বিকশিত কুঁড়ি অপেক্ষা
নতুন।
আমি'ই সমগ্র মনুষ্য জাতি
আর আমিই স্বর্গ, নরক,মর্ত ধারণ কারি শক্তি।
‘‘তা কি রূপে সম্ভব মাধব?
যাদব কূলে জন্ম আপনার আজ বলছেন অমর,
অনেকে দেখেছে জীবন দশায়!
খুলে বলুন আমারে জানতে চাই আপনারে,
চিন্ময়-চিরন্তন-অবিনশ্বর কি রূপে হয়?’’
তুমি কেবল শরীর দেখছ,
আর আমি বলছি আত্মার কথা!
জন্ম আমার হয়েছে অনেক
আজও অবতার রূপে আমি বিধাতা-
এখনো জন্ম নেবো বারংবার ;
যুগে-যুগে এসেছি মৃত্তিকায় মিশেছি
তবুও আজও আমি অমর অবিনশ্বর।
শুধু জেনে নাও, হে পার্থ ভক্তি যোগী হও-
হও আমার প্রতি সমর্পণ!
তবেই হবে ঈশ্বর দর্শন-
রণ যাত্রায়;
সমর্পণে ওই মনে আমাকে জানা
বাস্তবে হবে পরমাত্মা'কে চেনা
আর একেই জ্ঞান যোগ বলা হয়।
‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি ভর্বতি ভারত।
অভ্যুত্থান ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজম্যহম্।।
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চদুষ্কৃতাম।
ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।’’
অর্থাৎ যখনি ধর্মের অধঃপতন হয়,
হয় তখনি অধর্মের অভ্যুত্থান!
আর তখনি আমি স্বীয় মায়া বলে,
মনুষ্য দেহ ধারণ করে আসি ভূমণ্ডলে,
করি ধর্ম জ্ঞান দান-
করি অধর্মীদের বিনাশ;
সাধুদের রক্ষা করি, দুষ্টুদিগের মারি,
আগামী তেও এরূপ হবে করো বিশ্বাস।
আসক্তিরহিত, ক্রোধবর্জিত, ও ভয়শূন্য
ব্যক্তি হয় আমার শরণাগত,
জ্ঞান রূপ করে তপস্যা!
তাই শুদ্ধি লাভ করে, ব্রহ্ম ভাবে পায় আমারে,
করে মোক্ষ লাভ আমি ভক্তের ভরসা।
আমিই পরমাত্মা অবিনশ্বর
ধরেছি কত অবতার,
ব্রহ্ম, বিষ্ণু, মহেশ্বর -
কখনো বামন, কখনো পরশুরাম!
আর আমিই রামচন্দ্র ছিলাম।
আমি না পুরুষ, আর না স্ত্রী,
আর না তো শরীর!
আমি জ্ঞান,আমি মহান
আর আমিই সৃষ্টি পরম ব্রহ্ম শ্রেষ্ঠ বীর।
যিনি যে প্রকারে আমার উপাসনা করে,
আমি তারে সে রূপ ফল দিয়ে অনুগৃহীত করি;
ধর্মনিষ্ঠ মানুষ সকলে, সকল প্রকার সর্বকালে-
আমার পথ অনুসরণ করে ছেড়েছে তরি।
তাই পার্থ তুমি আরো জানো, চার বর্ণের কথা শোনো,
সত্ত্বাদিগুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে করেছি সৃষ্টি!
এই বর্ণ বিভাগ কেবল মাত্র
বর্ণনা করে মানুষের বৈশিষ্ট্য-চরিত্র,
কিন্তু এক বর্ণ আর এক বর্ণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নয় -
সেখানে রাখো দৃষ্টি।
তুমি আরো জেনে নাও এই দুঃসময়ে জাগ্রত হও
কর্ম ও অকর্মের করছি আলোচনা!
শাস্ত্রবিহিত কর্ম, নিষিদ্ধ কর্ম ও অকর্মের তত্ত্বে
হও অবগত,
হে অর্জুন আজ কর্মে থাকো রত-
অজ্ঞানে, মোহে,করোনা মিথ্যা বাহানা।
যিনি কর্মে অকর্ম ও অকর্মে কর্ম করেন দর্শন,
তিনিই জ্ঞানী এবং কর্ম করে গ্রহণ-
আর এটাই কর্ম ও অকর্মের প্রকৃত রহস্য!
এই জ্ঞানে'ই মুক্তি লাভ হয়, ভুলে যাও জয়পরাজয়,
হইও না তুমি উপহাস্য।
অহংকার ও কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা যিনি করে না,
তিনি কর্মে আবদ্ধ হন না -
অর্থাৎ জ্ঞানীরা কর্মে হয় তৃপ্ত!
হে অর্জুন, অজ্ঞানজাত,বুদ্ধিত্থিত,আত্মবিষয়ক
এই সংশয়,
জ্ঞান রূপ অসি দ্বারা ছেদন করে করো লয়-
ব্রহ্ম দর্শনের শ্রেষ্ঠ মার্গে, নিষ্কাম কর্মযোগী হও আগে,
হও যুদ্ধার্থ উত্থিত।
✍-উজ্জ্বল সরদার আর্য
রচনাকাল - ৩ মে ২০২০ সাল,
বাংলা,২০ বৈশাখ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (রবিবার)
দাকোপ খুলনা, বাংলাদেশ।