জাগো অর্জুন
✍- উজ্জ্বল সরদার আর্য
(প্রথম সর্গ)
যুদ্ধের দিনে অচেতন মনে,
কি ভাবছো বসে নীরব-নির্জনে?
রথ প্রস্তুত, প্রস্তুত সারথি-
হতে হবে রণক্ষেত্রে উপস্থিতি,
এসো হে-পার্থ ফিরে তব আসনে।
‘‘না মাধব, আপনি পূজনীয়-শ্রেয়
সারথি হতে পারেন না!
বিশ্বাস নেই? উত্তম রথ চালক আমি,
হতে হবে তোমায় বিশ্ব সংগ্রামী-
(তবু আপনার স্থান নিচে না)।’’
স্থান উপর-নিচের কি তাৎপর্য?
হইও না তুমি আশ্চর্য।
তথাপি তোমার যেন সন্তোষ হয়
দিতে চাই সংশয়ে অভয়
স্থান লও অগ্রভাগে!
যতক্ষণ লাগাম আছে হাতে
দেবো না বিক্ষিপ্ত হতে
সত্য মিথ্যা পেরিয়ে যাবো ন্যায়ে-
মনে জয় গীত জাগে।
রথ যুদ্ধের অথবা জীবনের হক
উত্তম সারথি আমি,
নির্ভয়-নির্ভর-নির্মল মনে
এসো হে পার্থ তুমি।
‘‘কিন্তু, যুদ্ধ আরম্ভ হবার পূর্বে
দুই পক্ষের সৈনিক করবো নিরীক্ষণ,
নিয়ে চলেন আমারে মধ্য ভাগে
করি শুধু গুরু-স্বজন দর্শন।’’
‘‘তবু গাণ্ডীব ধরো হাতে
হবে লড়তে
আজ কিসে এত চিন্তিত তুমি?
মৃত্যু'তে হবে ধর্ম স্থাপন
স্বজন মেরে শান্তি অনুধাবন,
এই যুদ্ধ করে কি পাবো আমি?’’
‘‘হারানো,প্রাপ্তি,এসব ব্যর্থ চিন্তা
যুদ্ধে হও মৌনতা
দিতে হবে আজ বলিদান!
কিন্তু এখানে লক্ষ সৈনিক দাঁড়িয়ে
এসেছে দু'পক্ষ নিয়ে
তারও যে দেবে প্রাণ দান।’’
তবে কি করে এত নিষ্ঠুর হবো,
কি করে করবো হত্যা?
আজ-আপন-স্বজন কাঁদছে এখন,
মায়াময়ী প্রাণে শুধু ব্যর্থতা।
‘‘আমি জানতে চাই,কিসের এই যুদ্ধ?
পারছিনা হতে ক্রুদ্ধ,
এসেছি দণ্ড দিতে,না করছি ধর্ম ক্ষয়?
সৃষ্টি -বিনাশে'র শক্তি আছে কি তোমার?
সে তো করে থাকে ঈশ্বর
তুমি মিথ্যা অহংকারকে করো জয়।’’
‘‘কিন্তু বিধ্বংস নয়, সৃষ্টি'কে বাঁচাতে চাই-
পীড়া প্রাপ্ত হক আরো আমার!
বিধ্বংস নব নির্মাণের কারণ পার্থ
ভুলে যেওনা এই তথ্য
তুমি গাণ্ডীব ধরো করো সংহার!’’
সকল মায়া মোহ্ ভুলে
সংসারের মঙ্গলে
যুদ্ধ করো,
দুষমন দের মারো-
জেগে ওঠো অর্জুন এবার।
‘‘কিন্তু আমি যে অচেতন
চেতনা দিয়ে পথ দেখাবে কে?
হে পার্থ, তুমি চিন্তে পারনি
আজ চিনবে আমাকে।’’
অহংকারে মুষ্টিবদ্ধ কি করে করবে যুদ্ধ
আজ সমর্পণে দাও অঞ্জলি!
যে জ্ঞান দিতে প্রস্তুত আমি,
তা গ্রহণ করবে কি তুমি?
পাঠ করি তবে ব্রহ্ম বিদ্যা গীতাঞ্জলী।
সংসার,আসলে কি জানা দরকার
মানব, দানব, পশু-পাখি,
জন্তু, কীট, যত দেখি -
এসব কি রূপে হয় সৃষ্টি?
কোন পদার্থে হয় জন্ম, কেন করে অপকর্ম,
কি রূপে চলাচল করে,কি রূপে মরে,
মৃত্যুর পশ্চাতে বা কি হয়,
এ-সবে কখনো রেখেছো দৃষ্টি?
‘‘হে মাধব, মানব দেহ মৃত্তিকায় হয় তৈরি
আরো বায়ু, আকাশ, আছে অগ্নি, বারি-
তাহলে কিসের মায়া, চিন্তা তোমার?
যত আপন-স্বজন আছে সৈনিকগন
এই পঞ্চভূত মিশ্রণে তৈরি দেহ সবার।’’
‘‘তবে তুমি কার মোহ করছো পার্থ,
মৃত্তিকার?
কিন্তু মাধব, এই মৃত্তিকার দেহ -
যেন তেজস্বী গ্রহ,
পরিচয়ে জয়ে পেয়েছি শুধু তার।’’
না পার্থ, যদি এটাই সত্য হয়
তবে মৃত্যুর পশ্চাতে দেহ কে-
কেন করা হয়-ক্ষয়?
বাস্তবে মানুষের পরিচয়, দেহের সাথে যুক্ত নয়-
নয় সম্পর্কের ভিত্তি শরীরের সাথে!
স্বভাব,আচরণ,কার্য করা হয় ধার্য
পরিচয়ে আছে গেঁথে।
আর এই গুলি কি রূপে তৈরি হয়
আগে বুঝতে হবে তোমায়,
মনুষ্য জীবন দৃশ্য আর অদৃশ্যে মিলন-মাত্র
তথাপি স্বভাব মানুষের ভিন্নতা পায়।
এর কারণ সৃষ্টির তিন গুন
তমঃ, রজঃ,সত্ত্ব!
এদের একত্র মিলনে স্বভাব রচিত হয় মনে
আজ উপস্থিত সকলে অকর্মে মত্ত।
কিন্তু মাধব, স্বভাব যদি হয় বংশগত
তবে তা থাকে পূর্ব হতে নির্ধারিত,
সিংহ হরিণ কে করে ভক্ষণ!
মৃগ হবে ভয়-ভিতু, হবে মৃত্যু-
তবে কিসের ধর্ম, কিসের দণ্ড-নির্ধারণ?
হে পার্থ, করেছো উত্তম প্রশ্ন
শুনে হয়েছি ধন্য,
কিন্তু প্রথমে জেনে নাও মানুষ কি!
পঞ্চভূত নয়, নয় জ্ঞানেন্দ্রিয় -
নয় কর্মেন্দ্রিয়, চেতনায় তারে আঁকি।
‘‘তবে কি মানুষ কেবলি চেতনা?
পূর্ণ করো প্রার্থনা;
চেতনায় সকল পদার্থ মিশ্রিণে
হয়ে ওঠে প্রকৃতি, তুমি কি যান না?’’
আর প্রকৃতিতে প্রস্তুত দেহ যন্ত্রে
বসবাস করে পুরুষ একান্তে,
প্রকৃতি ও পুরুষের মিল বন্ধনে
আত্মায় জীবিত হয় মানুষ মর্তে।
আত্মা কি মাধব?
বলুন, জানতে চাই আমি-
হতে পারছিনা সংগ্রামী।
মানুষ যেমন করে রথে'র ব্যবহার,
আত্মাও দিয়েছে শরীরে পর ভার-
সুখ,দুঃখ উপভোগ করে!
কিন্তু আত্মা শরীর নয়
হয় না সে ক্ষয়,
শুধু বৃক্ষের পাতা ঝরে।
অস্ত্র দ্বারা করা যায় না ছেদ,
অগ্নিতে হয় না ভস্ম!
জল করতে পারে না দুর্বল,
আত্মা অমর-অদৃশ্য।
শুধু পুরাতন কে ত্যাগ করে
নতুন দেহ কে করে ধারণ,
হে পার্থ! আত্মা দৃঢ় তর সনাতন।
কিন্তু মাধব , আমি আত্মা রূপে নিজেকে
চিনবো কি করে?
এতদিন শরীর অনুভবে আছি সংসারে।
যে ব্যক্তি নিজের মাঝে সর্ব সাজে
করে অন্বেষণ,
আমি ইন্দ্র নই, নই শরীর-
অনুভূতি নই, নই জ্ঞান স্থির
অন্তিমে একদিন জেনে যাবে তখন।
‘‘এই আত্মার কার্য করিতা কি মাধব?
জানতে চাই, বলুন আমায়।’’
যখন হলো পরম ব্রহ্ম বিভাজন,
পুরুষ তথা প্রকৃতির সৃষ্টি হলো তখন।
আর পরমাত্মার অংশ আত্মা
প্রকৃতির প্রত্যেক বস্তু'তে বসবাস করে,
সেই আত্মাকে মোহ তথা অন্ধকার
ধরে রেখেছে ঘিরে।
মোহ-নিদ্রিত সরিয়ে জাগ্রত হয়ে
কর্তব্য নিজেকে জানা,
এটাই আত্মার কার্য-প্রার্থনা।
কিন্তু মাধব,প্রত্যেক আত্মা পরমাত্মার
অংশ যদি হয়,
তাহলে উন্নতি-অধোগতি সয়ং
পরমাত্মা করায়?
যে প্রকার আবর্জনায় পতিত রত্ন
চক-চক করে না,
সে রূপে'ই প্রকৃতি'তে ঘেরা আত্মা
নিজেকে জানতে পারে না।
অধিকতর আত্মা নিজের দেহ কে
সবকিছু বলে গণ্য করে,
কিন্তু স্বয়ং সে দেহ থেকে ভিন্ন
জানতে চায় না ওরে।
তাই যারা জাগ্রত হতে চায় না
করে অধর্ম কলহ গঞ্জনা,
তাদের দণ্ড দেওয়া দরকার!
হে পার্থ, অস্ত্র ধরো যুদ্ধ করো
মুক্তি দাও এদের সবার।
তবে তুমিও জেনে নাও
যে তুমি কোন শরীর নও,
কেবলি এক আত্মা!
এই রণ ভূমিতে প্রত্যেক যোদ্ধা তা নয়
যা তুমি ভাবছো ভাই
এদের করতে পারবে না হত্যা।
কিছু সময়ে সৃষ্টির জয়ে
শরীরে করে বসবাস,
এদের হবে না মৃত্যু, হবে না ধ্বংস,
কিসের জন্য করছো হা-হুতাশ।
যতক্ষণ স্বয়ং শুদ্ধতা রূপে
না চিনবে,
ততক্ষণ এরা জন্মাতে-মরতে থাকবে।
যে জন্মেছে, সে মরেছে -
যে মরেছে,সে জন্মেছে-
এটাই ব্রহ্ম বিদ্যা'র প্রথম অধ্যায়!
আজ যে জ্ঞান করলে অনুধাবন
তাকেই সাংখ্য যোগ বলা হয়।
✍-উজ্জ্বল সরদার আর্য
রচনাকাল ২৫ এপ্রিল ২০২০ সাল
বাংলা-১২ বৈশাখ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (শনিবার)
দাকোপ খুলনা,বাংলাদেশ।