সনেট লেখার নিয়ম
ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস
অনধিকার চর্চাঃ প্রথমেই সকল কবিবন্ধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই বলে যে, এই লেখার যোগ্যতা আমার নেই। আমি সেই মাপের সাহিত্য বিশারদ নই। এই সাইটে সনেট লেখার সুবাদে অনেকের পরামর্শে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। তাছাড়া এই বিষয়ে বর্তমানে একটু চর্চা করেছি। তাই এই লেখা।
কেন এই লেখাঃ বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, আমাদের কবিতার আসরে অনেক কবি সনেট লেখার জন্য এগিয়ে এসেছেন। সেই সূত্রে অনেক কবির মনে প্রশ্ন দানা বেঁধেছে- সনেট লেখার প্রকৃত নিয়ম কী? অনেকে ব্যক্তিগতভাবে আমার নিকট থেকে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সর্বোপরি, গত ২০/০৯/২০১৬ তারিখে আলোচনা সভায় কবি অনুপম মণ্ডল “সনেট সম্পর্কে আলোচনা - মতামত আকাঙ্ক্ষী” একটি আলোচনা দেন। তাছাড়া এই আসরে আজ আমার ৫০ তম সনেট ( অনেকগুলি সনেট নয়) প্রকাশ করেছি। তাই আজ সনেট বিষয়ে অন্যান্যদের সাথে আমিও কিছু আলোচনা করতে চাই।
এই আসরে সনেট কবিতা ও আলোচনাঃ বিভিন্ন সময়ে এই আসরে অনেক কবি বন্ধু সুন্দর ভাবনার সনেট উপহার দিয়েছেন। তাদের মধ্যে মোঃ আব্দুল মান্নান, কবীর হুমায়ূন, প্রণবকুসুম দত্ত, কাজি সাগর অন্যতম। সনেট বিষয়ে আলোচনাও একেবারে কম হয়নি। গত ৩১/০৫/২০১৪ তারিখে “সনেট সম্পর্কে কিছু কথা” লেখেন কবি মোঃ আব্দুল মান্নান, ১১/০৬/২০১৫ তারিখে “ছন্দের খেলা (সনেট)” সম্পর্কে লেখেন শ্রদ্ধেয় কবি কবীর হুমায়ূন এবং ১৩/০৭/২০১৫ তারিখে “সনেটের সাতকাহন (প্রথম পর্ব)” লেখেন কবি প্রণবকুসুম দত্ত। তাছাড়া প্রতিনিয়ত সনেট কবিতায় বিভিন্ন কবিদের মন্তব্য কবিতার পাতাকে সমৃদ্ধ করেছে।
সনেট কীঃ ইংরেজ কবি কোলরিজ “সনেট” বলতে বুঝেছিলেন এমন এক ক্ষুদ্র কবিতা যাতে একটি অখণ্ড ও সংহত ভাবকল্পনা বা অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। (A small poem, in which some lonely feeling is developed.). ইতালিতে নব-জাগরণের যুগসন্ধিতে চতুর্দশ শতকে কবি পেত্রার্ক (Petrarch) সনেটের জন্ম দেন। অন্যান্য সনেট রচয়িতাদের মধ্যে কীর্তিমান দান্তে এবং ট্যাসো ছিলেন এই আদর্শের অনুসারী। বাংলা ভাষায় সনেটের উদ্গাতা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
সনেটের বৈশিষ্ট্যঃ সনেট বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা না করে আমি সরাসরি সনেট লেখার নিয়ম নিয়ে আলোচনা করছি।
ক) সনেট হল চতুর্দশপদী কবিতা। এ কবিতায় থাকবে চোদ্দটি পঙক্তি এবং প্রতি পঙক্তিতে চোদ্দ অক্ষর বা মাত্রা।
খ) কবিতায় দুটি ভাগ থাকবে। প্রথম ভাগঃ অষ্টক, অর্থাৎ আট পঙক্তি বিশিষ্ট। দ্বিতীয় ভাগঃ ষটক, অর্থাৎ ছয় পঙক্তি বিশিষ্ট।
গ) অষ্টক পর্বে প্রশ্ন কিংবা বিবরণের মাধ্যমে কবিতার মূল ভাববস্তুর আভাস দেওয়া হয়। এখানে দ্বন্দ্ব ও বিপন্নতার কথা উল্লেখ থাকে। আর ষটক পর্বে সেই প্রশ্ন বা অবতারণার উত্তর বা সমাপ্তি সূচিত হয়। মীমাংসা সম্পন্ন হয় এই অংশে। অষ্টকে ভাবের আবর্তন এবং ষটকে ভাবের নিবর্তন বিধৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ, অষ্টকে যে বক্তব্যের পরিবেশনা ঘটে; ষটকে তার পরিপূরক আবেগের উপসংহার করা হয়।
একটি উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-
“সমুদ্রতরঙ্গের উচ্ছ্বাস ও পতন যেমন তাল-লয় নিরবচ্ছিন্ন, সনেটের ভাব-তরঙ্গের উচ্ছ্বাস ও পতনও সেরূপ তাল-লয় নিরবচ্ছিন্ন। ফেনিলোচ্ছল সাগরতরঙ্গ যেমন ক্রমশ স্ফীত ও বর্ধিত হয়ে বেলাভূমির উপর আছড়ে পড়ে এবং নিমেষমাত্র স্থির থেকে আবার উজান বেগে সাগরগর্ভের দিকে ধাবমান হয়, সেরূপ ভাবের তরঙ্গ ছন্দোময়ী শব্দধারায় অষ্টকে উচ্ছলিত হয়ে বিপরীত নিবর্তনে ষটকে অবসান প্রাপ্ত হয়”।সনেটে বিষয় যেন স্পষ্ট হয়।
ঘ) ষটক পর্বের শুরুতে কবিতার মেজাজ বা প্রকাশের বদল থাকতে হবে।
ঙ) বিশেষ ছন্দ ও মিল বিন্যাস রীতি এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বিষয়টি একটু পরে আলোচনা করছি।
চ) ১৪ অক্ষর বা মাত্রা আবার বিভাজিত হবে ৮+৬ হিসাবে।
অর্থাৎ, “অর্থের গৌরব বৃথা হেথা- এ- সদনে
রূপের প্রফুল্ল ফুল শুষ্ক হুতাশনে,”
এখানে “অর্থের গৌরব বৃথা”ও “রূপের প্রফুল্ল ফুল” ৮ মাত্রা এবং “হেথা- এ- সদনে” ও “শুষ্ক হুতাশনে” ৬ মাত্রা।
ছ) সনেটগুলো সাধারণতঃ হয়ে থাকে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা।এখানে ঁ, ঃ, ং অক্ষর হিসাবে গণ্য হবেনা।
জ) সনেটে অক্ষর মাত্রা ও অন্ত্যমিল প্রধান।
ঝ) সনেট লেখার কাজটি কিঞ্চিৎ দুরূহ ও আয়াসসাধ্য। কবিকল্পনা এখানে নির্দিষ্ট নিয়মের অনুশাসনে সংযত।
ঞ) গীতি কবিতার অন্যান্য রূপের মতো কবিহৃদয়ের বাঁধা-বন্ধনহীন স্বতঃস্ফূর্তির সুযোগ এখানে কম।
ট) কবিতার প্রয়োজনে শব্দ ব্যবহার করতে হবে। শব্দ দিয়ে যেন কবিতা না গড়ে ওঠে।চাপিয়ে দেওয়া শব্দ চলবে না।
ঠ) এছাড়া সনেট পড়তে যেন অবশ্যই শ্রুতি মধুর হয়।
সনেটের ছন্দ রীতিঃ ছন্দ রীতি সনেটের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এর অন্ত্যমিল প্রধানত শেষ দুটি শব্দে হবে। এই অন্ত্যমিল অষ্টকে ১>৩, ২>৪ কিংবা ১>৪, ২>৩ এ হতে পারে।ষটকেও বিভিন্ন রকম পরিলক্ষিত।
ABAB:ABAB::CDECDE
ABAB:ABAB::CDCDEE
ABBA:ABBA::CDCDCD
ABBA : ABBA :: CDDCEE
AABB:CCDD::EEFFGG
ABBA:ABBA::CDCDEE
ABAB:ABAB::CDDCEE
ABCD:ABCD::EFGEFG
এছাড়াও নানারকম ছন্দরীতি দৃশ্যমান।
১৪ পঙ্ক্তিযুক্ত এবং সনেটীয় অন্ত্যমিল সম্পন্ন কবিতামাত্রই সনেট নয়।
একটি কবিতাকে আদর্শ সনেট বলা যাবে তখনই, যখন এর ভাব-প্রবাহ সনেটীয় রীতিতে প্রবহমান থাকবে এবং এর অন্ত্যমিলও সনেটীয় রীতি দ্বারা বিরচিত হবে।
এইসব উদাহরণ ও আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, সনেট নামক রূপকৃতির সুসংবদ্ধ ও সীমায়িত আঙ্গিক, মিলবিন্যাসের রীতি, রেওয়াজ ও ভাবগত এককেন্দ্রিকতা সত্ত্বেও তার অবয়ব ও ভাববস্তুর নানাদিক বিভিন্ন সময়ে কবিরা পরীক্ষা নিরিক্ষার স্তরে নিয়ে গেছেন। কিন্তু সনেটকে যদি কেউ নির্দিষ্ট্ ধারার কবিতা বলে উল্লেখ করেন, তবে, তার নিয়মকানুন পরিপূর্ণভাবে মেনে চলতে হয়।তা না হলে, তা প্রহসনে ঠেকে।
যদি কোনো কবিতাকে সনেট বলেন, তবে, তা পরিপূর্ণ সনেট হতে হবে। নচেৎ, তা না বলাই সঙ্গত। সব লেখাই কবিতা হতে পারে; কিন্তু সব কবিতা সনেট নয়।
সনেট বিষয়ে একান্ত আমার কথাঃ
আমি অন্যান্য ছন্দ সমন্বিত কবিতা অন্যত্র লিখলেও এই সাইটে শুধু সনেট প্রকাশ করি। সনেট লেখার ক্ষেত্রে আমার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি,সনেট হল কবিতার অনুশীলন, ভাবনার প্রকাশ এবং কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখা। আমার মনে হয় যারা সনেট লিখে কবিতা চর্চা করেন তারা যেকোনো ধারার কবিতা একেবারে সহজে লিখতে পারেন। দাবা খেলায় যেমন খেলোয়াড়কে ৬৪ খোপের প্রতি নজর রাখতে হয়, তেমনই এখানে ১৪X১৪=১৯৬ স্থানের প্রতি নজর রাখা লাগে। ভাবনার সাথে শব্দের খেলা ভারসাম্য রেখে চলে। প্রথমে ভাবনা আসে। তারপর লিখতে বসা। বহুবার কাটাকুটি এবং অক্ষরগত শব্দের প্রয়োগ চলতে থাকে। প্রথম দিকে সনেট বিষয়ে আমারও এত সূক্ষ্ম জ্ঞান ছিলনা। নানা গ্রন্থ এবং আলোচনা পড়ে সম্যক জ্ঞান লাভের চেষ্টা করছি। তবে একটা বিষয় উপলব্ধি করেছি, অনেক সময়ের চেষ্টায় সনেট সম্পন্ন হয়। অন্তত বিছানায় ঘুমাতে যাবার আগে স্মার্টফোন থেকে সরাসরি সনেট লেখা যায় না, কবিতা লেখা যেতে পারে।
সহায়ক গ্রন্থঃ
১) সাহিত্যের রূপ-রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ --- কুন্তল চট্টোপাধ্যায় ।
২) ছন্দ সমীক্ষণ ---আবদুল কাদির।
৩) এই সাইটের সনেট বিষয়ক আলোচনা।
পুনশ্চঃ সনেট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য কাঙ্ক্ষিত। এই আলোচনা সমৃদ্ধ করতে আরও সংযোজন প্রয়োজন। এখানে কবিদের লেখার উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করা হয়নি। আগ্রহীরা উপরে বর্ণিত গ্রন্থ এবং এই জাতীয় গ্রন্থ পড়লে সমৃদ্ধ হবেন।