কবি-কবি ভাব ছন্দের অভাব (ছন্দ ও কবিতার পাঠ) –সাতঃ ছন্দের সাথে আবৃত্তির সম্পর্ক
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি স্বপনকুমার মজুমদার মহাশয়কে।
------------------------------------------------------------------------------
পূর্বপাঠ
৪) রবীন্দ্রকবিতায় ছন্দ
৫) তালে তালে ছন্দ
৬) কবিতার সংজ্ঞা ও উপকরণ
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়- ৭) ছন্দের সাথে আবৃত্তির সম্পর্ক
------------------------------------------------------------------------------
আমরা বিভিন্ন সময়ে কবিতা আবৃত্তি করে থাকি বা কবিতার আবৃত্তি শুনে থাকি। ছাত্রবেলা থেকে অনেকের মধ্যে এ অভ্যাস তৈরি হয়। নানা জায়গায় কবিতা আবৃত্তির প্রতিযোগিতা হয়। বুঝতে শেখার পর অনেকের মধ্যে এই আবৃত্তির প্রতি একটা স্বাভাবিক ঝোক আসে। অনেকে আবার পরিণত বয়সে একে জীবিকা হিসাবে বেছে নেন। ছন্দের সাথে আবৃত্তির একটা গভীর যোগ আছে। আজ আমরা এ বিষয়ে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। প্রথমে কয়েকটি কবিতার কিছু অংশ উল্লেখ করলাম যেগুলি বহুবার নানা জনের কণ্ঠে শুনেছি, যা আমাদের হৃদয়ে পৌঁছে গেছে।
১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “দুই বিঘা জমি” কবিতার কিছু অংশঃ
“নমঃনমঃনমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।“
২) সুকান্ত ভট্টাচার্য এর ‘আঠারো বছর বয়স’কবিতার কিছু অংশঃ
“আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা। “
৩) জসীমুদ্দিনের কবর কবিতার কিছু অংশঃ
“এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মত মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।“
কি অনুপম! এই কবিতার আবৃত্তি যেন ফুটে ওঠে তার চিরায়ত এই ছন্দের মাধুর্যে। এই চিরায়ত কবিতাগুলি আমার নিজের বেশ প্রিয়। এগুলি নানাস্থানে আমিও আবৃত্তি করেছি। সব চেয়ে বড়োকথা হল এই কবিতাগুলি আমার মনে রাখার দরকার নেই; তবুও মনে আছে। এই মনে থাকার কারণ সেদিন হয়তো বুঝিনি। আজ বুঝি। তাই সবাইকে জানাতে চাই। এই কবিতা ও আবৃত্তির মূলে আছে কবিতার নিপুণ ছন্দ। যা কবিতাকে কিছুতেই ভুলতে দেয় না।
এ আলোচনার ব্যাপারে আমরা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের “ছন্দ ও আবৃত্তি” প্রবন্ধটিকে বেছে নিয়েছি এখানে। কবি ১৯৪৪ সালে এই প্রবন্ধটি লেখেন। এবার সহজেই ভাবতে পারি কিশোর কবি কবিতা লেখার ক্ষেত্রে বেশিদিন সময় পাননি। তবু তিনি ছন্দের অন্যতম হিতৈষী ছিলেন। এই তথ্য অনেক কবির কাছেই অজানা। কবি তাঁর প্রবন্ধের শুরুতেই ছন্দ বিষয়ে কবি বলেছেন-
“বাংলা ছন্দ সম্পর্কে এ কথা স্বচ্ছন্দে বলা যেতে পারে যে, সে এখন অনেকটা সাবালক হয়েছে। পয়ার-ত্রিপদীর গতানুগতিকতা থেকে খুব অল্পদিনের মধ্যেই বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যের প্রগতিশীলতায় সে মুক্তি পেয়েছে।“
এই আলোচনায় আবার কবি জানালেন-
“অতঃপর অভিযোগ-প্রসঙ্গ—ভাল ছন্দ ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য মনে হচ্ছে। এর প্রতিকারের কোনো উপায় কি নেই? আহার্যের সঙ্গে সঙ্গে ভাল ছন্দ দুর্লভ হওয়ায় দুটোর মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনে দুরভিসন্ধি মনের মধ্যে অদম্য হয়ে উঠছে, সুতরাং ভীতি-বিহ্বল-চিত্তে কবিদের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপ লক্ষ্য করব। কোনো কোনো কবির ছন্দের আশঙ্কাজনক প্রভাব অধিকাংশ নবজাত কবিকে অজ্ঞাতসারে অথবা জ্ঞাতসারে আচ্ছন্ন করছে, অতএব দুঃসাহস প্রকাশ করেই তাঁদের সচেতন হতে বলছি। খ্যাতনামা এবং অখ্যাতনামা প্রত্যেক কবির কাছেই দাবি করছি, তাঁদের সমস্তটুকু সম্ভাবনাকে পরিশ্রম করে ফুটিয়ে তুলে বাংলা ছন্দকে সমৃদ্ধ করার জন্যে। এ কথা যেন ভাবতে না হয় রবীন্দ্রনাথের পরে কারো কাছে আর কিছু আশা করবার নেই। “
এই প্রবন্ধে কবি ছন্দ ও আবৃত্তি বিষয়ে বললেন-
“এইবার আবৃত্তির কথায় আসা যাক। ছন্দের সঙ্গে আবৃত্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, অথচ ছন্দের দিক থেকে অগ্রসর হয়েও বাংলা দেশ আবৃত্তির ব্যাপারে অত্যন্ত অমনোযোগী। আমি খুব কম লোককেই ভাল আবৃত্তি করতে দেখেছি। ভাল আবৃত্তি না করার অর্থ ছন্দের প্রকৃতি না বোঝা এবং তারও অর্থ হচ্ছে ছন্দের প্রতি উদাসীনতা। ছন্দের প্রতি পাঠকের ঔদাসীন্য থাকলে ছন্দের চর্চা এবং উন্নতি যে কমে আসবে, এতো জানা কথা। “
কবিতার আবৃত্তির সাথে কবির ভাবনার কী নিবিড় যোগ তা এই কথা থেকেই স্পষ্ট। এর সম্ভাবনা তাই তিনি বললেন-
“সুতরাং বাংলা ছন্দের উন্নতির জন্য সুষ্ঠু আবৃত্তির প্রচলন হওয়া দরকার এবং এ বিষয়ে কবিদের সর্বপ্রথম অগ্রণী হতে হবে। অনেক প্রসিদ্ধ কবিকে আবৃত্তি করতে দেখেছি, যা মোটেই মর্মস্পর্শী হয় না। বিশুদ্ধ উচ্চারণ, নিখুঁত ধ্বনি-বিন্যাস, কণ্ঠস্বরের সুনিপুণ ব্যঞ্জনা এবং সর্বোপরি ছন্দ সম্বন্ধে সতর্কতা, এইগুলি না হলে আবৃত্তি যে ব্যর্থ হয় তা তাঁদের ধারণায় আসে না। “
কবি তার লেখার মধ্যে দিয়ে ছন্দ-শিক্ষার ব্যবস্থা করেন তা হলেও জনসাধারণ উপকৃত হয়।
এ বিষয়ে কবির মত-
“ যদি সত্যিই ছন্দ সম্বন্ধে কাউকে সচেতন করতে হয় তা হলে তা কিশোরদের। তারা ছড়ার মধ্যে দিয়ে তা শিখতে পারে। আর তারা যদি তা শেখে তা হলে ভবিষ্যতে কাউকে আর আবৃত্তি-শিক্ষার জন্যে পত্রিকায় লেখা লিখতে হবে না। কাজেই ভাল আবৃত্তি ও ছন্দের জন্যে একেবারে গোড়ায় জল ঢালতে হবে এবং সেইজন্যে মায়েদের দৃষ্টি এই দিকে দেওয়া দরকার। তাঁরা ঘুম-পাড়ানি গানের সময় কেবল সেকেলে ‘ঘুম-পাড়ানি মাসি পিসি’ না ক’রে রবীন্দ্রনাথ কি সুকুমার রায়ের ছড়া আবৃত্তি ক’রে জ্ঞান হবার আগে থেকেই ছন্দে কান পাকিয়ে রাখতে পারেন।“
পরিশেষে তিনি মন্তব্য করেছেন, “গদ্য-ছন্দের যে একটা বিশিষ্ট সুর আছে, সেটাও যে পদ্যের মতোই পড়া যায়, তা অনেকেই জানেন না। কেউ কেউ গল্প পড়ার মতোই তা পড়েন। সুতরাং উভয়বিধ ছন্দ সম্বন্ধে যত্ন নিতে হবে লেখক ও পাঠক উভয়কেই। কবিরা নতুন নতুন আবৃত্তি-উপযোগী ছন্দে লিখলে (যা আধুনিক কবিরা লেখেন না) এবং পাঠকরা তা ঠিকমতো পড়লে তবেই আধুনিক কবিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে, উপেক্ষিত আধুনিক কবিতা খেচর অবস্থা থেকে ক্রমশ জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর হবে। “
কবি ছন্দের নানাদিক বলার সাথে সাথে ছন্দ বিষয়ে আসা নানা অভিযোগ ও তার প্রকৃত সম্ভাবনাকে আহবান করেছেন বিভিন্ন উপমার সাহায্যে। ছন্দ ও আবৃত্তি বিষয়ে এই সব লেখা দেখে অনেকে ভাবতে পারেন এখানে আলোচকের ব্যাখ্যা কোথায়? সব তো কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলে গেছেন। ঠিক। এ কথা সত্য। আসলে আমাদের অনেকের কাছে ধারনায় নেই সেই সময় কবিরা ছন্দ মেনে কীভাবে পথ হেঁটেছেন। তাঁরা আগে ছন্দকে আয়ত্ত করতেন। জানার চেষ্টা করতেন। আমাদের অনেকের কাছে অজানা যে, কবি সুকান্তের এমন একটি প্রবন্ধ আছে। এবং তিনি নিয়ত এর চর্চা করেছেন।
এই আলোচনার থেকে আমরা সহজেই ছন্দের সাথে আবৃত্তির সম্পর্ক বুঝতে পারি। ছন্দহীন আবৃত্তি কখনোই সার্থক হতে পারে না।
***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’ (প্রবন্ধ) - কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯৪৪)
-----------------------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ 'সুকান্ত সমগ্র' থেকে সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি পাঠ করতে অনুরোধ করি। তারপর এই বিষয়ে কোনো মতামত থাকলে জানাবেন।
--------------------------------------------------------------
***বিঃদ্রঃ এই আলোচনা যে সবার ভালো লাগবে তেমন নয়। আসুন, এই আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গঠনমূলক মন্তব্য করি।