কবি-কবি ভাব ছন্দের অভাব (ছন্দ ও কবিতার পাঠ) –ছয়ঃ কবিতার সংজ্ঞা ও উপকরণ
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল মহাশয়কে।
------------------------------------------------------------------------------
পূর্বপাঠ
৩) ছন্দের সংজ্ঞা
৪) রবীন্দ্রকবিতায় ছন্দ
৫) তালে তালে ছন্দ
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়- ৬) কবিতার সংজ্ঞা ও উপকরণ
------------------------------------------------------------------------------
আমরা অনেকেই কবিতা রচনা করি। কিন্তু কবিতার প্রকৃত সংজ্ঞা জেনে ওঠা সম্ভব হয়নি অনেকেরই। কবিতারও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা কেউ দিতে পারেননি। এক এক জন এ বিষয়ে ভিন্নরকম ধারণা প্রকাশ করেছেন মাত্র। অনেক ইংরাজি ও বাংলা ভাষার কবিগণ এ বিষয়ে নানান সংজ্ঞা দিয়েছেন। আমি দেশি-বিদেশি বিখ্যাত কয়েকজন কবির কবিতা সম্পর্কিত মতামত তুলে ধরলাম এখানে। কবিতার ছন্দ বোঝার আগে কবিতার সংজ্ঞা, স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
১। পণ্ডিতপ্রবর স্যামুয়েল জনসন তাঁর 'অভিধানে' কবিতাকে বলেছেন- 'metrical composition' অর্থাৎ 'ছন্দোবদ্ধ রচনা'।
২। মেকলে বলেছিলেন- 'চিত্রকর রং দিয়ে যা করেন, কবি তাই করে থাকেন শব্দের মাধ্যমে'।
৩। ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন- ‘Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings'.
৪। কোলরিজের কাছে কবিতা 'Best words in the best order' অর্থাৎ 'সেরা শব্দসমূহের শ্রেষ্ঠ বাণীবিন্যাস'।
৫। শেলির ভাবনায়- 'the expression of the imagination' অর্থাৎ ''কল্পনার অভিব্যক্তিই কবিতা'।
৬। এডগার এলান পো বুঝেছিলেন- 'the rhythmic creation of beauty' অর্থাৎ 'সৌন্দর্যের ছন্দিত সৃজন'কে।
৭। ওয়াটস ডানটন কবিতাকে বুঝেছিলেন এভাবে- 'আবেগমণ্ডিত ও ছন্দিত ভাষায় মানবমননের মুর্ত ও শিল্পিত প্রকাশ'কে।
৮। দান্তে বলেছেন- 'সুরে বসানো কথাই হল কবিতা'।
৯। রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন- 'সেটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা যার অনুবাদ সম্ভব নয়'।
১০। মালার্ম বুঝেছেন- 'শব্দই কবিতা'।
১১। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতার সংজ্ঞা দিতে যেয়ে বলেছেন- 'রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই’ কবিতা'।
১২। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন- 'উপমাই কবিতা'।
১৩। কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন- 'ছন্দে সমর্পিত শব্দের নামই কবিতা'।
১৪। সৈয়দ শামসুল হক এর মতে-'কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ'।
১৫। আল মাহমুদ বলেছেন- 'পাখির নীড়ের সাথে নারীর চোখের সাদৃশ্য আনতে যে সাহসের দরকার' সেটাই কবিতা।
এভাবেই প্রায় সমস্ত প্রসিদ্ধ কবিরা কবিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন।
অর্থাৎ কবিতা প্রসঙ্গে সহজে একথা বলা যায় যে, শব্দ ও অর্থের সহযোগে মানবমনের ভাব-কল্পনা যখন অনুভূতিরঞ্জিত যথাবিহিত শব্দ বিন্যাসে তথা অর্থ ব্যঞ্জনায় ছন্দময় রূপ পরিগ্রহ করে তখন আমরা তাকে বলি কবিতা।
কবি কল্পনার রসদীপ্তি ও আবেগমণ্ডিত অবশ্যম্ভাবী বাণী-বিন্যাস কবিতাকে অন্য সব সাহিত্যরূপের থেকে আলাদা করে রাখে। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে যে অপরূপ শব্দচিত্র বা দৃশ্য আঁকা হয় তার মধ্যে অরূপের সন্ধান অর্থাৎ অন্তর্গত অনুভূতির রসে ভিন্ন কোনো অর্থের আবহ তৈরি করাই কবিতা। কিন্তু আমাদের অর্থময় চেনাজগতের বাস্তব শব্দ দিয়ে তো আসলে অবাস্তব কিছু নয় বরং আমাদের চেনাদৃশ্য বা বাস্তব আদলই তৈরি করা যায়। তাই এ বাস্তবতাকে তীর্যকভাবে দেখার প্রয়োজনেই চলে এল প্রতীক, উপমা, রূপক ইত্যাদির আলংকারিক ব্যবহারের মাধ্যমে চিত্রকল্প সৃষ্টির এক শিল্পীত প্রবণতা। যথাযোগ্য শ্রেষ্ঠ শব্দগুলোকে শ্রেষ্ঠ বিন্যাসের মাধ্যমে এক অপরূপ শব্দ কবিতার সঠিক চিত্র তৈরি হতে সাহায্য করে। এখানে প্রকাশের বর্ণনাময় আতিশয্যে রহস্যবিহীন, নিরাভরণ ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এক রূপকল্পের মায়াবিয়ানা। এই আধা-কল্পনার এক স্পন্দনশীল মূর্তিই হল কবিতা। বলাবাহুল্য যে, ছড়া, কবিতা ও পদ্যরচনায় ছন্দের ব্যাকরণ ১০০% অনুসরিত হলেও গদ্যকবিতার ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা রয়েছে এবং তা কেবল অন্ত্যমিলেরই স্বাধীনতা, অন্যকিছু নয়।
কবিতার প্রধান উপকরণ দুটি।
ক) অলংকার ও
খ) ছন্দ।
আবার সূক্ষ্মভাবে বিচার করতে গেলে বলা যায় উপকরণের সংখ্যা দুটি নয়, চারটি। সেগুলি- অলংকার, চিত্রকল্প,ছন্দ ও ছন্দস্পন্দ। অলংকারকে কবিতার বহিরঙ্গ সৌন্দর্য না বলে তার অন্তরঙ্গ বা অবিচ্ছেদ্য উপাদান বলাই ভালো। চিত্রকল্পকে বলা যেতে পারে কবিতার প্রাণ। অলংকার যে কবিতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এরকম কথা বিভিন্ন প্রবন্ধে লিখেছেন। প্রতিদিনের ব্যবহৃত ভাষা থেকে একে পৃথক করবার যে আয়োজন তাকেই আমরা বলি অলংকার। আর কবিতাকে বাঁধার মাধ্যম হল ছন্দ। আবার ছন্দের প্রায়োগিক যে ঝোঁক সেটিই ছন্দোস্পন্দ।
যেমন- “পোস্তা বাজারে গিয়ে জানতে পারলুম তোমার মেয়ের নাকি বিয়ে” এই গদ্য মাধ্যমকে কবিতার নানা উপকরণে কবি সাজালেন এভাবে-
"শুনতে পেলাম /পোস্তা গিয়ে
তোমার নাকি/ মেয়ের বিয়ে। "
এখানে অলংকার, চিত্রকল্প, ছন্দ ও ছন্দোস্পন্দ সব কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায় সুন্দরভাবে।
***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১)সাহিত্যের রূপ-রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ- কুন্তল চট্টোপাধ্যায়
২) সাহিত্য প্রকরণ- হীরেন চট্টোপাধ্যায়
৩) কবি-কবি ভাব ছন্দের অভাব- শাহ আলম বাদশা
---------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ 'কবিতা’' বলতে আপনি ঠিক আর কী বোঝেন। সেই সাথে কোনো কবি বা কবিতা গবেষকের দেওয়া কবিতার একটা সংজ্ঞা লিখুন। যা এই আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
--------------------------------------------------------------
***বিঃদ্রঃ এই আলোচনা যে সবার ভালো লাগবে তেমন নয়। আসুন এই আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গঠন মূলক মন্তব্য করি।