কবি-কবি ভাব ছন্দের অভাব (ছন্দ ও কবিতার পাঠ) –তিনঃ ছন্দের সংজ্ঞা
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস

------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি কবীর হুমায়ূন মহাশয়কে।
------------------------------------------------------------------------------
পূর্বপাঠ
১) ছন্দ, ছন্দময়তা ও ছন্দপতন  
২) কবিতা ও ছন্দ
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়-  ৩) ছন্দের সংজ্ঞা
------------------------------------------------------------------------------
ছন্দ ও কবিতা নিয়ে আলোচনার এই পর্যায়ে আমরা আজ ছন্দ নিয়ে কিছু বলব। প্রথমে ছন্দের সংজ্ঞা জেনে নিই। সংস্কৃত ও বাংলায় নানাজন নানাভাবে ছন্দের সংজ্ঞা দিয়েছেন।
১) 'সিদ্ধান্ত কৌমুদী' তে বলা হয়েছে 'চন্দয়তি হ্লাদয়তি ইতি ছন্দঃ' অর্থাৎ যা আনন্দ দান করে তাই ছন্দ।
২) ভাষাতাত্ত্বিক আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে “ বাক্যস্থিত পদগুলিকে যেভাবে সাজাইলে বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় ও তাহার মধ্যে কালগত ও ধ্বনিগত সুষমা উপলব্ধ হয়, পদ সাজাইবার সেই পদ্ধতিকে ছন্দ বলে।"
৩) অধ্যাপক আচার্য অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় ছন্দের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন- "যেভাবে পদবিন্যাস করিলে বাক্য শ্রুতিমধুর হয় এবং মনে রসের সঞ্চার হয়, তাহাকে ছন্দঃ বলে।"
৪) আধুনিক কবি বুদ্ধদেব বসুর মতে “ কাব্যের প্রধান বাহন সেই সুনিয়ন্ত্রিত বেগ বিকশিত ভঙ্গি, যার নাম ছন্দ।“
৫) অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন ছন্দের সংজ্ঞা দিয়েছেন এই ভাবে- “ সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিমিত কাব্যবিন্যাসের নাম ছন্দ।“
৬) অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের মতে “ যে ললিত ও সুমিত পদস্থাপনায় কাব্যে ধ্বনিতরঙ্গ সৃষ্টি হয়ে থাকে তাকেই ছন্দ বলা হয়।“
৭) ছন্দের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ছান্দসিক জীবেন্দ্র সিংহরায় বলেছেন, “কাব্যের রসঘন ও শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাকে বলে ছন্দ”।
এই আলোচনার কিছুটা পূর্বাভাস আমরা প্রথম দিন দিয়েছি। তার মানে, ধ্বনির বিন্যাসের কারণে তার শ্রুতিমাধুর্য, সৌন্দর্য ও সুষমাই ছন্দ। ছন্দের সম্পর্ক, সৌন্দর্য ও সার্থকতা শব্দের উচ্চারণের সাথে সম্পর্কিত, বানানের  সাথে নয়।
কবিতা লেখা হয় দুটি উপায়ে, ছন্দকে সাথে নিয়ে আর ছন্দকে বাদ দিয়ে। অধিকাংশ বাংলা কবিতা লেখা হয় ও হয়েছে ছন্দের ব্যবহারে, এবং বাংলার ভান্ডারে রয়েছে সেই সমস্ত ছন্দ-রতনের বিভিন্ন উদাহরণ। সেইসব ছন্দ ও তাদের রূপ-রীতি পাঠকের কাছে পেশ করার উদ্দেশ্যে এই রচনার আয়োজন। চলতি ধারণায় ‘ছন্দ’ বিষয়টি শক্ত এবং ব্যাকরণের আওতায় পড়ে। কলেজে বাংলা বিষয়ের ছাত্রছাত্রীরাই শেখে ছন্দের নানারূপ ও রীতিনীতি। আশা করছি ছন্দকে সহজভাবে বোঝাতে গিয়ে আরও অনেক লেখক বা এই বাংলা কবিতা আসরের কবিরা তাদের অভিজ্ঞতার কথা লিখবেন, এবং সমবেত প্রচেষ্টায় ও গঠনমূলক আলোচনায় 'ছন্দ' সবার জন্য সহজগম্য বিষয় হয়ে উঠবে আগামীদিনের জন্য।
      মনোরম ছন্দে বহু কবিতা লিখেছিলেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, এবং বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিলেন “ছন্দের যাদুকর” নামে। তার লেখা কবিতা ‘পাল্কীর গান’। নীচে কবিতাটির অংশ বিশেষের উদ্ধৃতি করা হল।  
পাল্কী চলে!      পাল্কী চলে!
গগন-তলে       আগুন জ্বলে!
ময়রা মুদি        চক্ষু মুদি’
পাটায় বসে      ঢুলছে ক’ষে।
আসছে কা’রা’    হন হনিয়ে?
হাটের শেষে      রুক্ষ বেশে
ঠিক দু’পুরে       ধায় হাটুরে!
      অংশগুলি পড়তে পড়তে অনুভব হয় এক ধ্বনিতরঙ্গের। সে কানে আনে এক আওয়াজ, যা পাল্কী কাঁধে চলতে গিয়ে বেহারাদের শরীরে দোলা দিয়ে। কবিতার চিত্র, কোনো গাঁয়ে এক রোদজ্বলা দুপুরে প্রায় নিশ্চলজীবন। সেখানে গতি আনে পাল্কী বাহক বেহারা আর হাটুরে, যাদের চলা হনহনিয়ে। আমাদের চেতনায় অনায়াসে জায়গা করে নেয় চলার সেই ধ্বনি।  
‘ছোটো খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া’ দিয়ে যে বইটির শুরু, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘সহজপাঠ’, তার সহায়তায় শুরু হয়েছিল আমাদের অনেকের বাংলা শেখা। সেই বইয়ের  কবিতা “আমাদের ছোটো নদী”। মিল ও চিত্রময়ী বর্ণনার গুণে, সে নদীর কথা মনে থাকে সহজে। জানবার ইচ্ছে হয়, কোন ছন্দে কবিতাটি লেখা হয়েছিল? ইত্যাদি। কবিতাটির প্রথম অংশ-  
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে,    
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
ছ্ন্দ বিষয়ে সেই সব কথা আমরা উপরে উল্লেখিত সংজ্ঞা থেকে ধীরে ধীরে বুঝে নিতে পারব।

***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
----------------------------------------------------------------------------
উৎস/ ঋণস্বীকার- 'বাংলা ছন্দ'- ডঃ রবীন্দ্রকুমার দত্ত, ত্রিপুরা।২০১৮
----------------------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ ছন্দ বিষয়ে আপনি পাঠ করেছেন এমন কোনো লেখকের একটি ছন্দের সংজ্ঞা এখানে লিখুন। সম্ভব হলে এমন কিছু লিখুন যা এই আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
----------------------------------------------------------------------------
***বিঃদ্রঃ এই আলোচনা যে সবার ভালো লাগবে তেমন নয়। যাদের এই ছন্দ নিয়ে আলোচনা পছন্দ নয়, তারা অনুগ্রহ করে দূরে থাকতে পারেন। যারা ছন্দ ভালোবাসেন ও শিখতে চান এই আলোচনা মূলত তাদের জন্য। তারা উত্সাহমূলক ও গঠনমূলক মন্তব্য দিয়ে আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবেন।