কবি-কবি ভাব ছন্দের অভাব (ছন্দ ও কবিতার পাঠ) –একঃ ছন্দ, ছন্দময়তা ও ছন্দপতন
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস
----------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল আসরের প্রিয়কবি ও এডমিন পল্লব আশফাক কে। আজ প্রিয়কবির জন্মদিন।
----------------------------------------------------------------------------------
প্রেক্ষাপট
        আজ ২৮ আগস্ট। আজ আমাদের এই বাংলা কবিতা আসরের প্রিয় প্রধান এডমিন ও প্রিয়কবি, গীতিকার পল্লব আশফাক এর শুভ জন্মদিন। এই দিনকে মর্যাদা দিয়ে নতুন কিছু করার তাগিদে এই আলোচনার শুভ পথচলা। আসরের নিয়ম-নীতিকে মান্যতা দিয়ে আমার সামান্য জ্ঞান ও ক্ষুদ্র সামর্থ্যে এই আলোচনা শুরু করলাম। আপনাদের ভালোবাসায় এর পথচলা। আপনারা চালিয়ে নিয়ে গেলে এর পথ মসৃণ হবে। অন্যথায় পথ হারাবে।
       আমাদের বাংলা কবিতার আসর সৌখিন কবিদের পীঠস্থান। এই আসর নানা বয়সের নানা পেশার নানা স্থানের নানা জাতির কবিদের এক মিলনমঞ্চ। সবাই আপন মনের খেয়ালে কবিতা লিখে চলেন। অনেক কবি অন্যের কবিতা পাঠ করেন ও গঠনমূলক মন্তব্য দিয়ে থাকেন। অনেকে বেশ সমৃদ্ধকবি। তারা নানাভাবে অপর কবিদের উৎসাহ দিয়ে থাকেন। তাছাড়া আলোচনার পাতাতেও নানাসময় নানা বিষয় উঠে আসে। অনেকে বিবিধ প্রশ্ন করেন। অনেকে আবার সুন্দর গঠনমূলক উত্তর দেন।
       বিভিন্ন সময়ে এই আসরের অনেক কবি ছন্দশিক্ষা বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়ে থাকেন। তারা হাতেকলমে ছন্দ শেখানোর বিষয়ে আগ্রহ দেখান। সে কথা ভেবে আর নিজে আরও সমৃদ্ধ হবার তাগিদে এই আসরের আলোচনার পাতায় শুরু করলাম এমন আলোচনা। এই আলোচনায় একদিকে ছন্দ বিষয়ক নানা কথা অন্যদিকে কবিতার নানা রূপ, অলঙ্কার, ব্যাকরণ আলোচনা করব। এই সাথে চাই আপনাদের সার্বিক সহযোগিতা। আমি যে সব জানি এমনটি ভাবার কারণ নেই। আমিও শিক্ষানবিস। তাই ছন্দ বিষয়ে অভিজ্ঞ কবিদের কাছে আমার অনুরোধ তারা এই আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন।
      প্রথমেই বলে রাখি, আসরের অনেকেই ছন্দ বিষয়ে অনেক ভালো জানেন। যারা ছন্দে সুপণ্ডিত, তাদের জন্য এই আলোচনা নয়। যারা ছন্দ জানেন না, বা জানলেও কবিতা লেখার সময়ে সঠিক ছন্দের তাল রাখতে পারেন না, বা ছন্দ জানার ইচ্ছা আছে তাদের জন্যই এই আলোচনা।  যদি আসরের একজন কবিরও লেখাটা উপকারে আসে, তাহলে আমার শ্রম সার্থক হবে।
----------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়- ছন্দ, ছন্দময়তা ও ছন্দপতন
----------------------------------------------------------------------------
      ছন্দ কোনো কঠিন বিষয় নয়। কিন্তু ছন্দ যেন সহজে রপ্ত হয় না, ছন্দ বেশ ধন্দ তৈরি করে। তাই সহজে ছন্দের ধারনায় প্রবেশ করা দরকার। এটা শেখার জন্য কোনো চিন্তা করার দরকার নেই। এটা যেন শেখার বিষয় নয়। শুধু জানার ব্যাপার। কিন্তু অনেক সময় আমরা দ্রুত শিখতে যাই বলে সমস্যা হয়। একটু ধীরে ধীরে শেখার দরকার। আমরা যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস নিই, এই বিষয়টা জানি; এটা ঠিক তাই। এটা আপনাআপনি যেন হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলি- এই আসরে আমি 'ছন্দ মেনে কবিতা' নামে একটা আলোচনা চালাই। সেখানে আমি কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণ করি। উত্তরে অনেক কবি আমাকে জানান তিনি ছন্দ মেনে লেখেননি। কিন্তু ঠিক ঠিক ছন্দে এসে গেছে। ঠিক তাই। এটা যেন স্বাভাবিক নিয়মে এসে যায়।
      শিশু জন্মের পর অনেকে তাকে ঘুম পাড়ায় বিভিন্ন পুরানো ছড়া আবৃত্তি করে। তখন তালে তাল রেখে শিশুর পিঠে আলতো থাবা দেয় সকলেই। তাই এটা সহজাত। কিন্তু সরল কথা সোজা করে বলা আমাদের পণ্ডিতদের ধাতে নেই। তাই ছন্দ আমাদের দূর আত্মীয় হয়ে ওঠে। তাই সহজ করে আমরা ছন্দকে জানব। আমরা সবাই কথা বলি। সবারই কথা বলার ভঙ্গি আলাদা আলাদা। এই ভঙ্গি মানে ধরন বা ধাঁচ। যা কিছু গতিময় বা চলমান তারই ছন্দ আছে। মানুষের কথা বলার মধ্যে ছন্দ আছে, হাঁটার মধ্যে ছন্দ আছে। গোরু- ঘোড়া- মোষ- হাতির চলার মধ্যেও ছন্দ আছে। আমরা বলি ঘোড়াটা দুলকি চালে চলছে। এই দুলকি চালে চলাটাই ঘোড়ার চলার ছন্দ। আকাশে পাখি উড়ে যায়, তারও ছন্দ আছে। আমরা বলি নদী কুলুকুলু রবে বয়ে যায়। এই কুলুকুলু রবে নিয়মিত বয়ে যাওয়াটাই নদীর ছন্দ। নদীতে নৌকা চলে তারও ছন্দ আছে। ছন্দ কোথায় নেই? ছন্দ সর্বত্র আছে।
ধরুন, ঘোড়া ছুটছে।
টগবগ- টগবগ- টগবগ
এখানে ঘোড়ার পায়ের ওঠা নামার মধ্যে একটা নির্দিষ্ট তাল আছে। যুদ্ধক্ষেত্রের ঘোড়া আর ভ্রমণকারী ঘোড়ার চলনের ভঙ্গিও আলাদা। আবার বেয়াড়া ঘোড়ার চলনে এজাতীয় কোনো ছন্দ নেই।
রেলগাড়ির চলার একটা ছন্দ আছে।
দাদা যায় দিদি যায় দাদা যায় দিদি যায় অনেকটা এরকম।
চলার এই সুসমঞ্জস ক্রমান্বয় হল ছন্দ।
নিয়মিত সূর্য ওঠে আবার অস্ত যায়। এসব হল ছন্দলীলা। আবার বেহিসেবী অঘটন ঘটে তবে সেটা ছন্দপতন।
বুকের উপর হাত রাখলে আমরা হৃদস্পন্দন পাই। সেখানেও একটা ছন্দ আছে।যদি সেই সুর বিঘ্নিত হয় অর্থাৎ হৃৎপিণ্ড লাফাতে থাকে তবে সেটা ছন্দপতন অর্থাৎ অসুখ। ডাক্তারবাবুরা ভালো বলতে পারবেন।
অর্থাৎ ছন্দ সামঞ্জস্য এর অপর নাম। সামঞ্জস্য হল সৌন্দর্য আর সৌন্দর্য হল আনন্দ।
কবিতা গদ্য ও পদ্য উভয় ভাবেই লেখা হয়। গদ্যছন্দ নিয়ে পরে আলোচনা করব। এখন আমরা পদ্যছন্দকে বুঝব।
শিশুরা যে ছড়া গুলি পাঠ করে তার সব ছন্দ আবদ্ধ।
"আতা গাছে তোতা পাখি
ডালিম গাছে মউ
এত ডাকি তবু কথা
কয়না কেন বউ।"
আবার
"আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে
সুর্য গেল পাটে;
খুকু যাবে জল আনতে
পদ্মদিঘির ঘাটে।"
এগুলি তাল দিয়ে দিয়ে সুন্দর ভাবে পাঠ করা যায়।
"অল্পেতে /খুশি হবে/ দামোদর/ শেঠ কি?
মুড়কির/ মোয়া চাই/ চাই ভাজা ভেটকি।"
এর প্রতিটি ক্ষেতেই একটা নির্দিষ্ট তাল আছে। অর্থাৎ ছ্ন্দ আছে।

***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
----------------------------------------------------------------------------
উৎস/ ঋণস্বীকার- বাংলা ছন্দের সহজপাঠ- সত্রাজিৎ গোস্বামী
----------------------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ এই অংশ পাঠ করে যদি ভালোলাগে তবে কিছু ছড়া কবিতা মন্তব্যের ঘরে লিখুন। আর পাঠ করুন। যারা ছন্দকে অস্বীকার করেন বা আলোচনার বিপক্ষে তারা ছোটো বাচ্চাদের উপযুক্ত ছন্দহীন ছড়া লিখুন। যা কিনা সুর দিয়ে পড়া যায়।
----------------------------------------------------------------------------
***বিঃদ্রঃ যারা ছন্দ আলোচনার বিপক্ষে তারা পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন। যারা ছন্দ ভালোবাসেন ও শিখতে চান এই আলোচনা মূলত তাদের জন্য।