ছন্দ ও কবিতার পাঠ –১৩ - অক্ষরের শ্রেণিবিভাগ
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী মহাশয়কে।
------------------------------------------------------------------------------
পূর্বপাঠ
১০)ছন্দের গুরুত্ব ও উপাদান
১১) ছন্দের উপাদান - ধ্বনি (বর্ণ,শব্দ)
১২) সিলেবল বা অক্ষর বা দল
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়- ১৩) অক্ষরের শ্রেণিবিভাগ (মুক্ত ও রুদ্ধ)
------------------------------------------------------------------------------
ছন্দ শেখার ক্ষেত্রে অক্ষর ও তার শ্রেণিবিভাগ জানা বেশ জরুরি। এই বিষয় ছাড়া ছন্দ ঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়। তাই এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দুইদিনে আলোচনা করা হল। ছন্দের মাত্রা বোঝার জন্য এই অক্ষরের ভাগ ভীষণ প্রয়োজনীয়।
ক) অক্ষরের অন্ত্যস্থিত ধ্বনির বিচারে অক্ষর দুই প্রকার।
অ) স্বরান্ত অক্ষর – এক্ষেত্রে অক্ষরের শেষাংশে স্বরধ্বনি থাকে। যেমন- মুনি। মু- র শেষে উ; নি- র শেষে ই।
আ) ব্যঞ্জনান্ত অক্ষর - এক্ষেত্রে অক্ষরের শেষাংশে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকে। যেমন- কণ্টক (কন, টক) কন এর শেষে ন; টক এর শেষে ক।
খ) উচ্চারণের বিচারে অক্ষরের দুটি ভাগ।
অ) মুক্ত অক্ষর – যে অক্ষর উচ্চারণকালে নিশ্বাসের গতিপথ মুক্ত থাকে, তাকে বলে মুক্ত অক্ষর। যেমন – আমি, কূলে, প্রেরণা।
আ) রুদ্ধ অক্ষর - যে অক্ষর উচ্চারণকালে নিশ্বাসের গতিপথ রুদ্ধ থাকে, তাকে বলে রুদ্ধ অক্ষর। যেমন – ক্ খ্ গ্ ইত্যাদি।
এবার বিস্তারিত ভাবে মুক্ত ও রুদ্ধ অক্ষর বিষয়ে জেনে নিই।
কোনো শব্দের উচ্চারণের সময়, এর পুরো অংশ বা কোনো অংশ বিশেষ নিশ্বাসের একক ধাক্কায় উচ্চারিত হয়। প্রথাগতভাবে এই উচ্চারণ প্রকৃতিকে অক্ষর (Syllable) বলা হয়। সাধারণত কোনো শব্দ উচ্চারণ করার সময়, শব্দের অংশ বিশেষ রুদ্ধ বা অবারিতভাবে উচ্চারিত হয়। ধ্বনির এই বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে, শব্দের অক্ষরকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। ভাগ দুটি হল-
১. রুদ্ধাক্ষর : যখন কোনো অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকে না, তখন অক্ষরটি প্রলম্বিত হয় না, তখন তাকে রুদ্ধাক্ষর বলা হয়। যেমন- কান। এখানে এই শব্দে অক্ষর রুদ্ধ হয়েছে।
২. মুক্তাক্ষর : যখন কোনো অক্ষরের শেষে স্বর থাকে এবং তা অক্ষরকে প্রলম্বিত করে, তখন তাকে মুক্তাক্ষর বলা হয়। যেমন- নদী। উচারণের বিচারে এর লিখিত রূপ হবে নো. দি। এখানে 'নো' এবং 'দি' উভয় ধ্বনিই রূদ্ধ হয় না। এই কারণে উভয় ধ্বনিই মুক্তাক্ষর হিসাবে বিবেচিত হয়।
ইংরেজিতে Syllable দু' প্রকার।
ক। Open Syllable ও খ। Closed Syllable,
তেমনি বাংলাতে অক্ষর দুপ্রকার।
ক। মুক্তাক্ষর এবং খ। বদ্ধাক্ষর।
যিনি ইংরেজি Syllable বুঝবেন তিনি বাংলার অক্ষরও বুঝবেন। তাই Syllable এর পাঠটা আগে ঝালিয়ে নিই।
Syllable এর সংজ্ঞা আগে আমরা দেখেছি। বাকি আছে Open Syllable এবং Closed Syllable কাকে বলে সেটা জেনে নেওয়া।
যে Syllable উচ্চারণের সময় বাতাস কোথাও বাঁধাপ্রাপ্ত হয় না এবং ধ্বনিকে ইচ্ছেমতো প্রলম্বিত করা যায়-সেই Syllable কে Open Syllable বা মুক্ত Syllable বলে। Open Syllable ই মুক্তাক্ষর।
যেমন: টেলিফোন (Telephone) শব্দের মধ্যে টে+লি ( Te+le) দুটো Open Syllable (মুক্তাক্ষর)কে পাঠক ইচ্ছেমতো টেনে টেনে পড়তে পারবেন। অপরদিকে Closed Syllable সেই Syllable কে বলে- যা উচ্চারণের সময় বাতাস বাঁধাপ্রাপ্ত হয়,অনিচ্ছাসত্ত্বেও থেমে যেতে হয়, শ্বাসে তালা লাগানো হয়। যেমন- ফোন (Phone) শব্দটি। এখানে বাতাস বা শ্বাসকে কিন্তু ইচ্ছেমতো প্রলম্বিত করা যাচ্ছে না, থামতেই হচ্ছে। তাই ফোন (Phone) Closed Syllable বাংলায় - বদ্ধাক্ষর। বদ্ধাক্ষরের পরিচয় আগে দিয়েছি। এখন সংযুক্ত ব্যঞ্জনটা চেনাবার পালা। সংযুক্ত ব্যঞ্জন হচ্ছে দুটো ব্যঞ্জনবর্ণ একসাথে যুক্তভাবে ব্যবহৃত হওয়া। যেমন: ক্ত, ম্ন,ম্ল, স্ম, হ্ন,হ্ণ, হ্ব, ব্দ, ন্থ প্রভৃতি। শব্দের ভেতরে তবে এদের প্রয়োগটা কেমন হচ্ছে? দেখুন: শক্ত, রক্ত,চিহ্ন, বহ্নি, অপরাহ্ণ, স্মরণ,স্মৃতি।
এসব উদাহরণ থেকে আমরা বদ্ধাক্ষর ও মুক্তাক্ষর বের করে আনতে পারি। যেমন: শক্ত: শক্ + তো (শক্ বদ্ধাক্ষর এবং তো মুক্তাক্ষর) রক্ত: রক্ + তো ( রক্ বদ্ধাক্ষর এবং তো মুক্তাক্ষর) স্মরণ: শ+ রোন্ (শ মুক্তাক্ষর এবং রোন্ বদ্ধাক্ষর) দেখতে পেলাম যুক্তব্যঞ্জন ভেঙেই বদ্ধাক্ষর গঠিত হচ্ছে। আশা করছি, ছড়া,কবিতা ও গানে ব্যবহৃত মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর সম্পর্কে আর কারও অসুবিধা থাকবে না।
অন্যনামে বা অন্যভাবে 'দল' দুই রকম, মুক্তদল ও রুদ্ধদল। যে দলের শেষে আশ্রিত ধ্বনি নেই, তাকে মুক্তদল (Open Syllable) বলা হয়। যেমন- অ, আ, ক, খ, সা, রে প্রভৃতি। মুক্তদলের উচ্চারণ হয় মুখ খুলে এবং মুক্ত কথাটি সে অবস্থা বোঝায়। মুক্তদলে থাকে মৌলিক স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণ। আবার যে দলের শেষে আশ্রিত ধ্বনি থাকে সে রুদ্ধদল (Closed Syllable)। যেমন- এক, কাজ, গান, তল, এই, বউ, শক্, ধিক্, প্রভৃতি।
***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) ছন্দ - ড. অমরেন্দ্র গণাই , কলকাতা।
----------------------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করুন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানিয়ে লেখাটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবেন।