ছন্দ ও কবিতার পাঠ –১২ - সিলেবল বা অক্ষর বা দল
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস  
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি শহিদ খান  মহাশয়কে।        
------------------------------------------------------------------------------
পূর্বপাঠ
৯) ছন্দ না জেনেও আমরা কীভাবে কবিতা লিখি
১০)ছন্দের গুরুত্ব ও উপাদান  
১১) ছন্দের উপাদান - ধ্বনি (বর্ণ,শব্দ)
------------------------------------------------------------------------------
আজকের বিষয়-  ১২) সিলেবল বা অক্ষর বা দল  
------------------------------------------------------------------------------
উচ্চারণ-সাধ্য ক্ষুদ্রতম ধ্বনির নাম 'অক্ষর' বা 'দল'। একটি শব্দের যতটুকু ধ্বনি একবারে বা একঝোকে উচ্চারিত হয়, তাই হল 'অক্ষর'। অক্ষর হল শব্দের পরমাণু। ছ্ন্দ জানার ক্ষেত্রে এই অক্ষরের গুরুত্ব অপরিসীম।
যেমন- 'সুমন্ত' একটি শব্দ। এটি উচ্চারণ করছি তিন বারে বা তিন ঝোঁকে। অর্থাৎ সুমন্ত = সু/মন/ত। অর্থাৎ 'সুমন্ত' শব্দে অক্ষর আছে তিনটি। আবার,
'মা' শব্দে ঝোঁক ১, অক্ষর ১ (মা)
'মামা' শব্দে ঝোঁক ২, অক্ষর ২ (মা,মা)
'মামার' শব্দে ঝোঁক ২, অক্ষর ২ (মা,মার)
'মামারা' শব্দে ঝোঁক ৩, অক্ষর ৩ (মা,মা,রা)
এবার বিস্তারিত জেনে নিই।
সাধারণ ভাবে বাংলায় 'অক্ষর' শব্দটি বর্ণের সমার্থক শব্দ হিসাবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ধ্বনিতত্ত্বে 'অক্ষর' পৃথক একটি অর্থ বহন করে। কথা বলার সময় বড়ো ধরনের বিরাম পাওয়া যায় দাঁড়ি চিহ্নের পরে। অল্প বিরামের জন্য ব্যবহার করা হয় কমা, সেমিকোলন। কিন্তু, একটি পুরো বাক্যের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, বাক্যের অন্তর্গত শব্দগুলির ভিতরেও আরও বিরাম আছে। কথা বলা বা শোনার সময় প্রতিটি শব্দকেই নিরেট বলে মনে হয়। অর্থাৎ শব্দের ভিতরে ধ্বনিগত কোনো ফাঁক-ফোকর যেন খুঁজে পাওয়া যায় না। ধ্বনিবিজ্ঞানীরা শব্দের ব্যাপারে এতে সন্তুষ্ট নন। শব্দকে খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে, তাঁরা ফাঁক-ফোকর বেশ ভালোভাবেই শনাক্ত করতে পারেন। যেমন- 'কুঞ্জ'। সাদামাটাভাবে শুনলে মনে হবে এর ভিতরে কোনো ফাঁক - ফোকর নেই। কিন্তু ভালোভাবে বিচার করলে দেখা যাবে- 'কুঞ্জ' শব্দটি উচ্চারণে বক্তা উচ্চারণ করেন— কুন+জো হিসাবে। অর্থাৎ 'কুন' বলার পর ধ্বনি থেমে যায় এবং এর পরে 'জো' উচ্চারিত হয়। কিন্তু 'কুঞ্জ' শব্দটি এত চর্চিত অভ্যাসে এত দ্রুত উচ্চারণ করা হয় যে, এর ভিতরের বিচ্ছিন্ন ভাবটা আছে বলে মনে হয় না।
      ইংরেজি ভাষা অক্ষরের প্রতিশব্দ syllable। যাঁরা বাংলা কাব্যের ছন্দের বিচার করেন, তাঁরা অক্ষরকে ভিন্ন ভিন্ন নামে চিহ্নিত করেছেন। যেমন— অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন 'অক্ষর' –কে 'দল' নামে অভিহিত করেছেন। আবার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এর নামকরণ করেছিলেন 'শব্দপাপড়ি'। মূলত শব্দের ক্ষুদ্রতম ধ্বনি একক, যা একটি শ্বাসাঘাতে সৃষ্টি হয়। অক্ষরের এই ধারণাটা পরিস্কারের জন্য আমরা ইংরাজি  Syllable এর সহায়তা নিতে পারি। Syllable কী? Syllable হচ্ছে এক প্রয়াসে উচ্চারিত শব্দাংশ। যেমন: Phone এই শব্দের ভেতর পাঁচটি letter আছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে Syllable আছে মাত্র একটি। আবার দেখুন Telephone শব্দটি উচ্চারণ করছি Te+Le+Phone বাংলায় লিখলে: টেলিফোন- টে+লি+ফোন, ইংরাজিতে বললে তিনটি Syllable আর বাংলায় বললে তিনটি অক্ষর রয়েছে টেলিফোন শব্দটির মধ্যে। আবার দেখুন টেলিফোন Telephone বাংলায় লিখলে কার চিহ্ন ছাড়াই চারটি বর্ণ আছে, আর ইংরেজিতে Letter আছে নয়টি। যখন এটাকে অক্ষর বা Syllable হিসাব করব, তখন পাব মাত্র তিনটি অক্ষর বা Syllable.
        একটি শ্বাসাঘাতে উচ্চারণযোগ্য ক্ষুদ্রতম ধ্বনি একক যদি অক্ষর হয়, তাহলে প্রশ্ন হল- এই এককের সীমারেখা কীভাবে নির্ণয় করা হবে। প্রকৃতপক্ষে উচ্চারণযোগ্য ধ্বনিগুলির মূল একক হল— বর্ণ। এর ভিতরে স্বরধ্বনিগুলি স্বাধীনভাবে উচ্চারণ করা যায়। কিন্তু স্বরধ্বনির সাহায্য ছাড়া ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ করা অসম্ভব। অবশ্য একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়ে যে যুক্তধ্বনি তৈরি হয়, সেখানে আদ্য ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ পাওয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত স্বরধ্বনির দ্বারাই তার মুক্তি ঘটে। যেমন- ম্র। এখানে ‘ম’-এর ধ্বনিরূপ স্বরধ্বনি ছাড়াই পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ম+র উচ্চারণের সাথে স্বরধ্বনি যুক্ত না করলে কোন ধ্বনিরই মুক্তি ঘটবে না।
     স্বরধ্বনি এককভাবে একটি অক্ষর তৈরি করতে পারে। কিন্তু ব্যঞ্জনধ্বনির সাহায্যে অক্ষর তৈরি হলে তার আগে বা পরে স্বরধ্বনি যুক্ত হবে। যদি ব্যঞ্জনধ্বনিটি অক্ষরের শুরুতে থাকে, তবে তাকে বলা হবে অক্ষরাম্ভ আর ব্যঞ্জনধ্বনিটি পরে থাকলে তাকে বলা হয় অক্ষারান্ত। ব্যঞ্জনধ্বনিযুক্ত অক্ষরে একাধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত হয়ে ব্যঞ্জনগুচ্ছ তৈরি করতে পারে। তবে এর সাথে অবশ্যই স্বরধ্বনি থাকবে। প্রধানত চার ভাগে অক্ষর বা দল গঠিত হয়।
১. অক্ষরকেন্দ্র (শুদ্ধ স্বরধ্বনি): এক্ষেত্রে শুধু মাত্র স্বরধ্বনি দিয়ে একটি অক্ষর তৈরি হয়।    
                যেমন— অ, আ, ও ইত্যাদি।
(এ নহে ফুলহার, ও যাবে না, এ আবার কেমন কথা। ইত্যাদি।)
২. অক্ষারম্ভ ব্যঞ্জন : এক্ষেত্রে ব্যঞ্জনধ্বনির পরে স্বরধ্বনি যুক্ত থাকবে।
                যেমন— মা =ম্ +আ, বৌ= ব+ওউ।
৩. অক্ষরান্ত ব্যঞ্জন  : এক্ষেত্রে ব্যঞ্জনধ্বনির আগে স্বরধ্বনি যুক্ত থাকবে।
                যেমন— আম =আ +ম্, ইট= ই+ট। ইত্যাদি।
৪. অক্ষারম্ভ-অক্ষরান্ত : এক্ষেত্রে স্বরধ্বনির উভয়পার্শ্বে ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত থাকতে পারে।
                যেমন— গান= গ্‌+আ+ন্, কাক= ক+আ+ক। ইত্যাদি।
আর একবার তাহলে অক্ষর কে সহজে জেনে নেওয়া যাক।
বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে বা একঝোঁকে শব্দের যে অংশটুকু উচ্চারিত হয়, তাকে অক্ষর বা দল বলে। যেমন- 'চিরজীবী'- একটি শব্দ, এখানে চারটি অক্ষর আছে। চি/ রো/ জী/ বী চারটি অক্ষর।
        বাংলা ছন্দে অক্ষর বা দলের গুরুত্বঃ
ক) 'অক্ষর' হল ক্ষুদ্রতম ধ্বনি; সুতরাং অক্ষরই শব্দ নির্মাণ করে;
খ) 'অক্ষর' শব্দ উচ্চারণকে সুস্পষ্ট করে;
গ) অক্ষরের উচ্চারণ থেকেই লয় বোঝা যায়।
ঘ) 'অক্ষর' থেকে মাত্রা নিরুপিত হয়। যা থেকে পর্ব, পদ প্রভৃতি অনুমিত হয়।

অক্ষরের শ্রেণিবিভাগ আগামী পাঠে।  
***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে। পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) বাংলা ছন্দ - ড. রবীন্দ্রকুমার দত্ত , ত্রিপুরা।
----------------------------------------------------------------------------
আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করুন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানিয়ে লেখাটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবেন।