ছন্দ ও কবিতার পাঠ –<পর্ব-৯, ভাগ-৮৭> – কবিতার বিষয়শ্রেণি
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস  
-------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ – বিরহের কবিতা
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি আশীষ আচার্য মহাশয়কে।          
------------------------------------------------------------------------------
বিরহের কবিতা
বাংলা সাহিত্য তথা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে 'বিরহ' অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে। বিরহ ছাড়া যেন কবিতা বা কাব্য আসে না বলে অনেকের ধারণা। বিভিন্ন পদাবলি ধারা থেকে এই বিরহের উৎপত্তি। যত কবিতা প্রেমকে নিয়ে লেখা হয়েছে, তার থেকে বিরহকে নিয়ে বেশি লেখা হয়েছে বলে ভাবা হয়। বিরহের কবিতা লিখতেই যেন কবির কাব্য ভাবনা শুরু হয়। এই বিরহ হতে পারে তার প্রেমিক/প্রেমিকাকে নিয়ে,  স্ত্রী/ স্বামীকে নিয়ে, দেশ/ সমাজকে নিয়ে বা অপর কোনো কারণে। আমাদের বাংলা কবিতার আসরেও বিরহের কবিতা লেখার স্থান রয়েছে। নীচে কিছু বিরহমূলক কবিতা তুলে দেওয়া হল।

১)মন ভালো নেই - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়
এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী এমনকি নারী এমনকি নারী
এমনকি সুরা এমনকি ভাষা
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কী আছে অথবা কী ছিল
আমার কী আছে অথবা কী ছিল
ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
তবু দিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায় ..

২)মনে পড়ে- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
ভুলে গেলে ভাল হত, তবু ভোলা গেল না এখনও।
পঁয়ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে, তবু কোনো-কোনো
মুহূর্তে তোমাকে মনে পড়ে।
স্রোতের গোপন টানে ভেসে যায় পিতলের ঘড়া।
অথচ বেদনা তার থেকে যায়। তাই বসুন্ধরা
কেঁপে ওঠে ফাল্গুনের ঝড়ে।
মনে পড়ে, মনে পড়ে, এখনও তোমাকে মনে পড়ে।

৩) ফুটেছে ফুল, বিরহী তবু চাঁদ- মহাদেব সাহা
ফুটেছে ফুল ঠোঁটের মতো লাল
আকাশে চাঁদ- বিরহী চিরকাল;
কে যেন একা গাইছে বসে গান
সন্ধ্যা নামে, দিনের অবসান।
দুর পাহাড়ে শান্ত মৃদু পায়ে
রাত্রি নামে স্তব্ধ নিঝুম গাঁয়ে;
শূন্যে ভাসে মেঘের জলাশয়
এই জীবনে সবকিছুইতো সয়।
বিরহী চাঁদ মোমের মতো গলে
বুকের মাঝে কিসের আগুন জ্বলে;
মন পড়ে রয় কোন অজানালোকে
নিজেকেই সে পোড়ায় নিজের শোকে।
ফুটেছে ফুল ঠোঁটের মতো লাল
বিরহী চাঁদ বিরহী চিরকাল;
ফুটেছে ফুল বিরহী তবু চাঁদ,
বাইরে আলো, ভেতরে অবসাদ

৪) শূন্যের ভিতরে ঢেঊ- শঙ্খ ঘোষ
বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শুন্যতাই জানো শুধু? শুন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?

৫) আমি একা, বড়ো একা- শক্তি চট্টোপাধ্যায়
চন্দনের ধূপ আমি কবে পুড়িয়েছি
মনে নেই। মন আর স্মৃতিগুলি ধরে না আদরে।
সংশ্লিষ্ট চন্দন এই অবহেলা সহ্য করে গেছে।
কখনো বলেনি কিছু, বলেনি বলেই পরিত্রাণ
পেয়েছে সহজে, নয়তো অসহ্য কুঠারে ধ্বংস হতো।

আমার সংহারমূর্তি দেখেছে চন্দন একদিন
কিশোর বয়সে, সেই অভিপ্রেত সুকালে, সময়ে।
দেখেছে এবং একা-একা ভয়ে-রহস্যে কেঁপেছে–
বলেছে, আমার দুটি সুগন্ধি কৌটায় হাত রাখো,
পায়ের নখর থেকে জ্বালিও না শিখর অবধি
আমি একা, বড়ো একা, চন্দনের গন্ধে উতরোল।।

৬) আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে- জসীমউদ্দীন
আমার বন্ধু বিনোদিয়ারে
প্রাণ বিনোদিয়া;
আমি আর কতকাল রইব আমার
মনেরে বুঝাইয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
কি ছিলাম, কি হইলাম সইরে, কি রূপ হেরিয়া,
আমি নিজেই যাহা বুঝলাম না সই, কি কব বুঝাইয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
চোখে তারে দেখলাম সইরে! পুড়ল তবু হিয়া,
আমার নয়নে লাগিলে আনল নিবাইতাম কাঁদিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
মরিব মরিব সইরে যাইব মরিয়া,
আমার সোনা বন্ধুর রূপ দিও গরলে গুলিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।
আগে যদি জানতাম বন্ধু যাইবা ছাড়িয়া,
আমি ছাপাইয়া রাখতাম তোমার পাঁজর চিরিয়ারে;
প্রাণ বিনোদিয়া।

**সংযোজিত হবে।
***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) বাংলা কবিতার আসর
                    ২) ইন্টারনেট।
----------------------------------------------------------------------------
আসরের কবিদের কাছে আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করবেন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানাবেন।