ছন্দ ও কবিতার পাঠ –<পর্ব-৯, ভাগ-৮৫> – কবিতার বিষয়শ্রেণি
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস
-------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ – মানবতাবাদী কবিতা
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি আলমগীর সরকার লিটন মহাশয়কে।
------------------------------------------------------------------------------
মানবতাবাদী কবিতা
যে কবিতা মানুষের কথা বলে, চেতনার কথা বলে, সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে থেকে কথা বলে সেটাই মানবতাবাদী কবিতা। আমাদের দেশের, সমাজের নানা রকম মানবতাবাদী কথা বিভিন্ন কবি বিভিন্ন সময়ে রচনা করে গিয়েছেন। সমসাময়িক ঘটনা বা ইতিহাসকে সাথী করে এজাতীয় লেখা হয়ে উঠেছে এই কবিতার প্রধান প্রতিপাদ্য। এই কবিতায় জেগে ওঠে কবির প্রতিবাদ। মানবতার রঙে সেগুলি হয়ে ওঠে রাঙা। নীচে এ জাতীয় কিছু কবিতা তুলে দেওয়া হল।
১) দরিদ্র - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-(সোনার তরী)
দরিদ্র বলিয়া তোরে বেশি ভালোবাসি
হে ধরিত্রী, স্নেহ তোর বেশি ভালো লাগে,
বেদনাকাতর মুখে সকরুণ হাসি,
দেখে মোর মর্ম-মাঝে বড়ো ব্যথা জাগে।
আপনার বক্ষ হতে রস-রক্ত নিয়ে
প্রাণটুকু দিয়েছিস সন্তানের দেহে,
অহর্নিশি মুখে তার আছিস তাকিয়ে,
অমৃত নারিস দিতে প্রাণপণ স্নেহে।
কত যুগ হতে তুই বর্ণগন্ধগীতে
সৃজন করিতেছিস আনন্দ-আবাস,
আজো শেষ নাহি হল দিবসে নিশীথে--
স্বর্গ নাই, রচেছিস স্বর্গের আভাস।
তাই তোর মুখখানি বিষাদ-কোমল,
সকল সৌন্দর্যে তোর ভরা অশ্রুজল।
২)কান্ডারী হুশিয়ার! - কাজী নজরুল ইসলাম
দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।
তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার
গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!
কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!
৩) ১লা মে-র কবিতা '৪৬ - সুকান্ত ভট্টাচার্য (ঘুম নেই)
লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে,
কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায়?
কতদিন তুষ্ট থাকবে আর
অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়ে?
মনের কথা ব্যক্ত করবে
ক্ষীণ অস্পষ্ট কেঁউ-কেঁউ শব্দে?
ক্ষুদিত পেটে ধুঁকে ধুঁকে চলবে কতদিন?
ঝুলে পড়া তোমার জিভ,
শ্বাসে প্রশ্বাসে ক্লান্তি টেনে কাঁপতে থাকবে কত কাল?
মাথায় মৃদু চাপড় আর পিঠে হাতের স্পর্শে
কতক্ষণ ভুলে থাকবে পেটের ক্ষুদা আর গলার শিকলকে?
কতক্ষণ নাড়তে থাকবে লেজ?
তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো,
অস্বীকার করো বশ্যতাকে।
চলো, শুকনো হাড়ের বদলে
সন্ধান করি তাজা রক্তের,
তৈরী হোক লাল আগুনে ঝল্সানো আমাদের খাদ্য।
শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে গজিয়ে উঠুক
সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে।।
৪) মানুষের সাথে থাকো - মহাদেব সাহা-(মানুষ বড়ো ক্রন্দন জানে না)
যতোই ব্যথিত হও মানুষের সান্নিধ্য ছেড়ো না
মানুষের সাথে থাকো সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে,
যতোই আঘাত পাও মানুষকে কিছুতে ছেড়ো না
যখন কিচুই নেই মনে রেখো,
তখনো সর্বশেষ আশা এই মানুষ;
সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও তোমার পাশে এসে মানুষই
দাঁড়াবে
ফুল যখন ফুটবে না, পাখি যখন গাইবে না
কেবল আকাশ-বাতাস মথিত করে আসবে ধ্বংস,
আসবে মৃত্যু
তখনো মানুষই তোমার একমাত্র সঙ্গী;
মানুষেল সব নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার পরও
মানুষই মানুষের বন্ধু।
অরণ্য নয়, পাহাড় নয়, সমুদ্র বা তৃণভূমি নয়
মানুষের হৃদয়ই তোমার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়
আর কোথাও নয় কেবল মানুষের হৃদয়েই মানুষ অমর।
মানুষকে এড়িয়ে কোনো সার্থকতা নেই
যতোই আঘাত পাও, যতোই ব্যথিত হও
মানুষের সঙ্গ ছেড়ো না,
মানুষের সাথে থাকো সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে
কেবল মানুষই এই মানুষের চিরদিন বাঁচার সাহস।
৫) শাসকের প্রতি - জয় গোস্বামী-(শাসকের প্রতি)
আপনি যা বলবেন
আমি ঠিক তাই কোরবো
তাই খাবো
তাই পরবো
তাই গায়ে মেখে ব্যাড়াতে যাবো
কথাটি না বলে
বললে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে থাকবো সারা রাত
তাই থাকবো
পরদিন যখন বলবেন
এবার নেমে এসো
তখন কিন্তু লোক লাগবে আমাকে নামাতে
একা একা নামতো পারবো না
ও টুকু পারি নি বলে
অপরাধ নেবেন না যেন
**সংযোজিত হবে।
***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) বাংলা কবিতার আসর
২) ইন্টারনেট।
----------------------------------------------------------------------------
আসরের কবিদের কাছে আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করবেন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানাবেন।