ছন্দ ও কবিতার পাঠ –<পর্ব-৮, ভাগ-৭৫> – কবিতার নানান ধারা
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস  
-------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ – মহাকাব্য (Epic)
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি জে. আর. এগ্নেস  মহাশয়াকে।          
------------------------------------------------------------------------------
মহাকাব্য
গাথাকাব্য ও কাহিনিকাব্যের মতো মহাকাব্যও আখ্যানকাব্যের শ্রেণিভুক্ত। মহাকাব্য হচ্ছে দীর্ঘ ও বিস্তৃত কবিতা বিশেষ। সাধারণতঃ এখানে দেশ কিংবা সংস্কৃতির বীরত্বগাঁথা এবং ঘটনাক্রমের বিস্তৃত বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা হয়। সুপ্রাচীনকালে মুখে মুখে প্রচলিত কবিতাসমগ্রও মহাকাব্যের মর্যাদা পেয়েছে। মহাকাব্য নিয়ে আলবার্ট লর্ড এবং মিলম্যান প্যারী গবেষণা করেছেন। তাঁরা উভয়েই যুক্তিপ্রদর্শন সহকারে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন যে, আধুনিককালের মহাকাব্যগুলি প্রকৃত অর্থে প্রাচীনকালের মৌখিকভাবে প্রচলিত ও প্রচারিত কবিতাসমগ্রেরই শ্রেণিবিভাগ মাত্র।
মহাকাব্য তন্ময় কাব্য। এটি ব্যক্তি-নিষ্ঠ নয়, বরঞ্চ বস্তু-নিষ্ঠ। লেখকের অন্তর অনুভূতির প্রকাশ নয়, বস্তু-প্রধান ঘটনা-বিন্যাসের প্রকাশ। গীতিকাব্যোচিত বাঁশির রাগিনী নয়, যুদ্ধসজ্জার তুর্য-নিনাদ। এছাড়াও, এটি মহাকায়, মহিমোজ্জ্বল, ব্যাপক হিমাদ্রি-কান্তির মত ধীর, গম্ভীর, প্রশান্ত, সমুন্নত ও মহত্ত্বব্যঞ্জক। এই কাব্যে কবির আত্মবাণী অপেক্ষা বিষয়বাণী ও বিষয় বিন্যাসই আমাদের অধিকতর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মহাকাব্য শ্রবকাব্যের একটি অংশবিশেষ। যে কাব্যে কোনো দেবতা বা অসাধারণ গুণসম্পন্ন পুরুষের কিংবা একবংশোদ্ভব বহু নৃপতি বা রাজা-বাদশাহর বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়, তা মহাকাব্য নামে পরিচিত। যিনি মহাকাব্য রচনা করেন, তিনি 'মহাকবি' নামে পরিচিতি পেয়ে থাকেন। দেবতা বা দেবতুল্য নায়কের বৃত্তান্ত নিয়ে বিশেষরীতিতে রচিত বৃহৎ কাব্য রচনাকে 'মহাকাব্য' নামে অভিহিত করা হয়।
মহাকাব্যে প্রাকৃতিক বিবিধ দৃশ্যমালা ও পরিবর্তন বর্ণিত থাকে এবং এতে কমপক্ষে আটটি কিংবা ততোধিক সর্গ বা ভাগ থাকে। যথাঃ রামায়ণ, মহাভারত, মেঘনাদবধ ইত্যাদি।
অল্প আয়তন ও ক্ষুদ্রাকৃতি খণ্ডকাব্যের (যেমনঃ মেঘদূত, সীতার বনবাস, শকুন্তলা ইত্যাদি) চেয়ে মহাকাব্যের প্রেক্ষাপট বিস্তৃত ও ব্যাপক।
মহাকাব্যের লক্ষণ -
১) মহাকাব্যের আখ্যানবস্তু হবে পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক;
২) মহাকাব্যের নায়ক কোনো দেবতা বা উচ্চবংশজাত বা নৃপতি;
৩) কম পক্ষে ৮টি বা সর্বাধিক ৩০ টি সর্গে মহাকাব্য বিভক্ত হবে;
৪) আশীর্বচন বা বস্তুনির্দেশ দিয়ে মহাকাব্যের আরম্ভ;
৫) মহাকাব্যের পটভূমি হবে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল প্রসারী
৬) মহাকাব্যে প্রকৃতিজগৎ, মিলন-বিরহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদির বর্ণনা থাকবে;
৭) রচনা হবে অলঙ্কারসজ্জিত বা রসভাব সম্বলিত;
৮) মহাকাব্যের ভাষা হবে ওজস্বী ও গাম্ভীর্য পূর্ণ;
৯) নায়কের জয় বা আত্মপ্রতিষ্ঠার মধ্যে মহাকাব্যের সমাপ্তি হবে।
১০) সাধারণতঃ এতে ট্র্যাজিডির স্থান নেই।

মহাকাব্যের শ্রেণিবিভাগঃ
তাত্ত্বিকেরা মহাকাব্যকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। (ক) জাত মহাকাব্য ও (খ) অনুকৃত মহাকাব্য।
জাত মহাকাব্য-
জাত মহাকাব্য হল প্রাচীনকালের নাম না জানা বিভিন্ন কবির মুখে মুখে রচিত বিভিন্ন কাহিনির সমন্বিত রূপ, যাকে কোনো একজন কবি একত্র করে অখণ্ড কাব্যরূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। যেমন 'রামায়ণ'। মুখে মুখে প্রচলিত রাম-সীতা-রাবণ-লক্ষ্মণের কাহিনি একত্র করে এই মহাকাব্যটি গ্রন্থিত করেছেন কবি বাল্মীকি। এ ধরনের মহাকাব্য রচিত হত প্রাচীন বিশ্বে। সারা দুনিয়ায় মোট ৫টি জাত মহাকাব্য স্বীকৃতি পেয়েছে।
১) রামায়ণ : মহাকবি বাল্মীকি রচিত প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত ভাষার মহাকাব্য।
২) মহাভারত : মহাকবি বেদব্যাস রচিত প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত ভাষার মহাকাব্য।
৩) ইলিয়াড : মহাকবি হোমার রচিত প্রাচীন গ্রিক ভাষার মহাকাব্য।
৪) ওডিসি : মহাকবি হোমার রচিত প্রাচীন গ্রিক ভাষার মহাকাব্য।
৫) গিলগ্যামেশ : কিউনিফর্ম লিপিতে লিখিত সুমেরিয়ান মহাকাব্য। (এটি পৃথিবীর প্রথম সত্যিকার বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম বলে বিবেচিত হয়। এর কবির নাম জানা যায়নি।)
অনুকৃত মহাকাব্য-
পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে একক কবির রচিত মহাকাব্য হল অনুকৃত মহাকাব্য।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১) বাংলা ভাষার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য (অনুকৃত)। ভার্জিলের ‘ইনিড’ (রোমান) আর মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ (ইংরেজি) পৃথিবীর সেরা দুই অনুকৃত মহাকাব্য। মহাকবি ফেরদৌসী কর্তৃক ফারসি ভাষায় রচিত অনুকৃত মহাকাব্য‘শাহনামা’। অনুকৃত মহাকাব্য রচনার ধারা আধুনিক যুগে কথাসাহিত্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

**সংযোজিত হবে।
***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) সাহিত্যের রূপ-রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ– কুন্তল চট্টোপাধ্যায়
                    ২) উইকিপিডিয়া।
----------------------------------------------------------------------------
আসরের কবিদের কাছে আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করবেন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানাবেন।