মাস খানেক হলো ক্যানসার টা ধরা পড়েছে –
ডাক্তারের দেওয়া মৃত্যুর সময়ও পেরিয়েছে-
নির্বিকার পড়ে আছি যন্ত্রণার কুড়েঘরে,
ফুসফুসের বাতাসে ওষুধের ঝাঁঝাল গন্ধ,
অতৃপ্ত পাকস্থলীর অপূর্ণাতার স্তুতি ক্রমশ বাড়ছে-
বাড়ছে প্রিয় মুখগুলোতে বিরক্তির রেখাচিত্র-
প্রথম প্রথম স্বজনেরা বসে থাকতো চারপাশে,
হয়ত মৃত্যু দেখার অভিলাষে।
এখন বিছানাটা মাছি আর মশা দের দখলে।
অতঃপর চোখেমুখে ভর করলো অস্পষ্টতা-
কানে এল বিলাপ আর কান্নার ধ্বনি
চোয়াল বেয়ে পড়ে গেল ছেলের হাতের পানি।
সাজু আমার বা হাতটা ধরলে-চোখে চোখ পড়লো ওর
জীবনের স্মৃতিগুলো ভেসে এলো জলোচ্ছ্বাসের মত,
খুবই কাছের বন্ধু আমরা দুজন-
মনে পড়ে সেই প্রথম দেখা ট্রেন?
২৭ বছর আগে, হুইসেল শুনে দৌড়ে দুজন স্টেশনে –
শুধু প্লাটফর্ম নয়-দেখেছিলাম নতুন একটা জীবন:
এন্টিক টাইপের দীর্ঘ মালগাড়ির নিচে শুয়েছিল দুটো কুকুর-
ঠিক পাশেই আম গাছটির নিচে ঝরা পাতার সাথে-
পড়েছিল কয়েকটি শুকনো প্রাণ।
পাশের রেলিং-এ পা তুলে প্রসাব করছিল এক ভদ্রলোক।
বৃদ্ধের মাছি গোফের নিচে জ্বলছিল সিগারেটের গদি-
চোখ জোড়া পিচুটি আর শুন্যতায় ঘেরা-
পাগলের মুখে ঝরছিল লালা।
পড়ে থাকা খালি বোতল নিয়ে-
দুই শিশুর মধ্যে চলছিল রেষারেষি।
প্লাস্টিকের পা আর ক্রাচ-ওয়ালাকে দিয়েছিলাম দশটি টাকা।
অতঃপর ট্রেন এল, চলে গেল, স্টেশন প্রায় ফাঁকা।
যাত্রীছায়ায় কয়েকজন যাত্রী গোসল করছিল-
লবন জল আর দাবদাহে,
মাথার উপর অকেজো ফ্যানটা-
ঝুলেছিল ফেলানির লাশের মত।
অন্ধের লাঠি সশব্দে পথ খুঁজেছিল এদিক ওদিক,
হাতে ধরা ভিখারী র থালায় তেরটি খুচরো পয়সা,
চোখে মুখে ফুটেছিল-
ঘামের লবন আর অসহায়ত্বের আলপনা।
ট্রেনের হুইসেল আর আগমনি ঘণ্টা-
আবিষ্ট করেছিল আমাকে,
একই সে ঘণ্টা শুনেছিলাম স্কুল ছুটির পরে,
-সেই সাতানব্বের শৈশবে,
-সতেরো'র যৌবনে,
-আজ আবার সাতান্নের বিকালে অপেক্ষায় স্টেশনে।
হাতে আজ ওপারের টিকিট-পোশাকে নেই শিল্পতা-
আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ছোট মেয়ে কবিতা-
চোখের কোনে গড়িয়ে পড়া জল মুছে দিচ্ছে কবিতার মা-
বাইশ বসন্ত আগের হাত দুটো আবারও আমার চুলে,
সবকিছু এত সহজে যায় কি যাওয়া ভুলে?
আমার নিঃশ্বাস যেন একটু বেশিই ভারি হল-
আরো ঝাপসা হয়ে এলো চোখের পাতা দুটো-
মহাকালের ট্রেন আজ যশোহর জং-এ; আমার সম্মুখে
ক্ষমা করো যেতে হবে এবার-
আদরের বাবা ডাক শুনবোনা কভু আর-
রেখে যাব শত স্মৃতি জননী কবিতার!!!