তোমার অফিসে যাওয়া
আমার কোনও কালেই পছন্দ ছিল না মা ।
একঘর লোকের মধ্যেও
কেমন খালি খালি লাগত ।
বড়বেলায় এসেও তো কত অনুরোধ করেছি মা,
যেও না ।
আমার এই চাওয়া, কোনও কালেই
তোমার স্নেহের স্পর্শ পায়নি ।
তোমার মনে পড়ে মা,
ছোটবেলায় কত করে পথ আটকেছি !
পিঠের বাঁপাশের চিহ্নটা মিলেয়ে গেছে অনেকদিন ।
চৌকাঠে, পাশের দেয়ালেও কি নেই, একটুও !
পথ আটকেছি,
তোমায় পারিনি ।
তোর মা যমের অফিসে চাকরী করে,
না গেলে চলবে না !
সেই তো একই সংলাপ
আমার শৈশব থেকে তারুণ্যের ভাঙা গড়ায়,
স্বপ্নের নবান্নে
ইলশেগুঁড়ি সান্ত্বনার ব্যর্থ প্রলাপ হয়ে ফিরেছে ।
আমাদের ছোটবেলায়
জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সেরে
তুমি অফিসে দৌঁড়তে ।
এ বাড়িতে এসে তুমি হাঁটতে ভুলে গিয়েছিলে মা ।
তুমি যখন বুকে পাথর চেপে
আমার হাত ছাড়িয়ে,
যা হোক কিছু একটা পরে
অফিসে চলে যেতে,
আমি তোমার ঘেমো শাড়িটা বুকে জড়িয়ে
খুব কাঁদতাম মা
আর গন্ধ শুঁকে শুঁকে জানালার দিকে তাকিয়ে
তোমায় খুঁজতাম ।
কতবার প্রতিজ্ঞা করেছি
আর কথা বলবো না তোমার সঙ্গে ।
কিন্তু আমার নৈঃশব্দ্য, সমস্ত মৌনতা, স্তুপীকৃত প্রতিজ্ঞা
তোমার ঘরে ফেরার গানে
অভিমানের রোয়াক পেরিয়ে
দাঁড়িয়ে পড়ত এক শব্দনীল সমঝোতায়;
বাধ্য পোষ্যের চলনে ফিরত-
ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে ।
নির্লজ্জ বেড়াল ছানার মতো
ঘুরঘুর ঘুরঘুর করতো,
সমস্ত শক্তি দিয়ে
তোমার গলা জড়িয়ে ধরে
ওই পাহাড়-ছেঁচা কাঁধে স্বর্গ খুঁজবে বলে ।
তখন ফোর্থ স্যাটার্ডে, স্যাকেণ্ড স্যাটার্ডের
হিসেব বুঝতাম না ।
শুক্রবার এলেই ভাই আর আমি
বারবার করে জানতে চাইতাম
আর তুমি শুধু শুধু বিরক্ত হতে ।
ও কথা বলতে তোমার এতো বিরক্তির
কারণটাও বুঝেছি অনেক পরে ।
রান্নার পিসি তোমার অফিস ছুটির বার্তায়
মনে মনে কেয়াবাত কেয়াবাত বলে
কেটে পড়ত যথাসময়ে ।
তোমার ছুটির পরোয়া করেনি কেউ,
করোনি তুমিও ।
তোমার গোড়ালি ফাটা পা, যতটা পথ হেঁটেছে-
পৃথিবীতে সত্যিই কি এতো পথ জন্ম নিয়েছে মা ?
রামায়ণ দেখতে বসে আমাদের লঙ্কাকাণ্ড,
শাড়ি পেঁঁচিয়ে শক্তিমান সাজার মহড়া,
সব সামলিয়ে
আমাদের মহাস্নান পর্বে
বাড়িময় চোর পুলিশ খেলা ।
ক্লান্ত হতে না তুমি ?
সত্যিই হতে না, একটুও !
পড়াতে বসে সে আর এক বিশ্বযুদ্ধ ।
পাটির তলায় ধারাপাতের আত্মগোপন,
ভোল পাল্টানো মানচিত্রে শুদ্ধ চিহ্নের মোড়লগিরি-
এমন অনেক জটিল রহস্য
গোয়েন্দার মতো ভেদ করতে তুমি ।
থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার থেকে
গুড, বেটার, বেস্ট এর সিঁড়িবদল কিংবা
'অন্ধজনে দেহ আলো'র সহজপাঠ---
ফোর্থ স্যাটার্ডের ক্যানভাস জুড়ে
আজও সেই তুমি
আর তোমায় ছুঁয়ে আমি ।
স্বপ্নের আশিয়ানায়,
কার্নিশ থেকে কালিম্পং-এ
তোমার শেখানো বুলিই জীবনের রং তুলি, মা ।