।   প্রতিটি যুদ্ধের পরে।

প্রতিটি যুদ্ধের পরে,
লাশের স্তুপের থেকে নিজের সন্তান ও ভাইদের
আলাদা করতে করতে হাহাকার করে ওঠে হোমো স্যাপিয়েন্স।

প্রতিটি যুদ্ধের পরে,
অজস্র গণকবরের স্মৃতি বুকে চেপে ঘরে ফিরে
হোমো স্যাপিয়েন্স  ধর্ষিতা মা বোন মেয়েদের মুখগুলো দেখে,
যাদের মগজ জুড়ে পুরুষ দেখলে বেজে ওঠে সাইরেন,
আজীবন না থামা তীক্ষ্ণ আওয়াজে।
  আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে চারিদিক হাতড়িয়ে
আতিপাতি করে সে খোঁজে সভ্যতা ঢাকবার আব্রু।

প্রতিটি যুদ্ধের পরে,
ক্লিন্ন অতীত ধরে ভিটে ফিরে হোমো স্যাপিয়েন্সের চোখে পড়ে,
এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে অনাথ শিশুরা,
কেউ অর্ধেক পোড়া, হাত নেই , পা নেই কারো,
সেইসব বিকৃত শৈশব বড় হলেও  ঘাড়ে বসে থাকবে সিন্দবাদ কাহিনীর বুড়োর মতো।
এর পরে, এক দুই তিন অথবা চারটে প্রজন্ম ধরে
এমন বিকলাঙ্গ সমাজ জন্মাতে থাকবে ,
যাকে ‘ বিশেষভাবে সক্ষম’ বলে মুখ রক্ষা করা যাবে না।
তাকে আটকানোর জন্য হাজার রকমের  রিহ্যাবিলেটশন প্রোগ্রাম চালু করে
অবশেষে সে বোঝে, সময়ের ফাটলে রিফু হয় না ।

প্রতিটি যুদ্ধের পরে,
হোমো স্যাপিয়েন্স দেখে ধ্বংস হয়ে গেছে জীবনের চেনা চিহ্নরা সব।
তার স্কুলের ওপর বোমা পড়ে সেটা এখন পরিত্যক্ত পোড়ো বাড়ি,
তার ঘরের পাঁচিল ভেঙে পাশের মাঠটা অবধি পড়ে আছে ঘষটানো দাগেদের হিজিবিজি,
যেখানে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ওরা একে একে গুলি করেছিলো তার বাবা, কাকা আর প্রতিবেশী চশমা-কাকুকে ।
যে বটগাছটার আড়ালে তার প্রথম চুমুর স্মৃতি,
ওরা তার ডালেই লটকে দিয়েছিলো গণধর্ষণের পরে তার প্রেমিকাকে,
বিষণ্ণ বাতাস এসে আজও দড়িটাকে দুলিয়ে দিচ্ছে পৈশাচিক পেন্ডুলামের মতো।
তার কলেজ যাওয়ার রাস্তায় মাইন ফেটে বড় বড় গর্ত হয়ে গিয়েছে,
প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে একজন নিখোঁজ,
একজন বিপরীতদিকের ইনফর্মোর সন্দেহে অকথ্য অত্যাচারে উন্মাদ,
আরেকজন জাতিগত সাফাই অভিযানের নামকরা খুনে।
বেঁচে যাওয়া নেড়িটার ল্যাজ নাড়া ছাড়া,
জীবনের একটি জিনিসও আর আগের মতো নেই।
উদভ্রান্ত পথিকের মতো হোমো স্যাপিয়েন্স ঢোকে তার ঘর বলে চেনা চৌহদ্দিতে,
ভাঙা আয়নার কাঁচে মুখ দেখে ভয়ানক চমকিয়ে ওঠে।
প্রতিবিম্বের থেকে চেয়ে আছে এক অচেনা আগন্তুক,
যার সব আলো কোনো এক কৃষ্ণগহ্বর হাঁ করে গিলে নিয়েছে।

প্রতিটি যুদ্ধের পরে,
হোমো স্যাপিয়েন্স দেখে চারিদিকে ভাঙা মূর্তির টুকরো পড়ে আছে।
বুদ্ধের পাথুরে প্রতিমা ভেঙে টুকরো  হয়ে ছড়িয়ে আছে,
অভয়মুদ্রার সবকটি আঙুল ভাঙা,
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর স্ট্যাচুটাকে কারা যেন উপড়ে ফেলেছে,
কাত হয়ে পড়ে বাপু পা বাড়িয়ে আছেন ,
কিন্তু কোথাও পৌঁছচ্ছেন না,
নেলসন ম্যান্ডেলার কেউ মাথা ভেঙে দিয়ে গেছে,
কবন্ধ সে মূর্তি কোনো হরর ফিল্মের থেকে কম বীভৎস নয়,
মার্টিন লুথার কিংয়ের গায়ে বিঁধে আছে অজস্র বোমার শ্রাপনেল।
হোমো স্যাপিয়েন্স নিজেকে বোঝাতে চায়,
এই সব আবার ঠিক তৈরি করে নেওয়া যাবে,
ঘন হয়ে আসা অন্ধকার তার কানে কানে বলে যায়,
ভেঙে গেলে ইতিহাস বদলায় না।

প্রতিটি যুদ্ধের পরে,
সমস্ত  হারিয়ে ফেলে  হোমো স্যাপিয়েন্স শোকার্ত হাহাকারে সময়কে প্রশ্ন করে,
এই সীমাহীন  ধ্বংসের  দায় কার?
আমার প্রজন্ম ছিন্নভিন্ন করে চলে গেলো কোন ঘাতকের তলোয়ার?

লাশের পাহাড় থেকে গলিত আঙুল ওঠে,
ধর্ষিতা নারীদের ঠোঁটে অভিযোগ ফোটে
বিপন্ন শৈশবে আচমকা কথা জোটে,
ভাঙা স্কুল মূর্তি ও উড়ে যাওয়া রাস্তারা আচমকা করে ওঠে জোরে চিৎকার,

দশখানা দিক থেকে
প্রতিধ্বনিরা বলে.. তোমার .. তোমার..

আর্যতীর্থ