। প্রথম কবিতা।

পৃথিবীর প্রথম মানুষের দলে, একটা খাপছাড়া মানুষ ছিলো।
বাকিরা যখন বুনো শুওর বা অ্যান্টিলোপ মারতে ব্যস্ত,
তখন সেই হিংস্র কোলাহলেও
তার চোখে পড়ে যেতো
বনে ফোটা থোকা বুনো ফুল,
পরাজিত প্রাণীটার লাশ বয়ে নিয়ে যেতে যেতে,
গাছের বাকল-পোশাকে সে গুঁজে রাখতো লতা দিয়ে সযত্নে বাঁধা গোছাটিকে।
বাকিরা অবাক হয়ে দেখতো মেয়েটির দিকে,
খাওয়া যায় না,
পরা যায় না,
অস্ত্র বানাতে কাজে লাগে না,
থেঁতো করে প্রলেপ বানানো যায় না,
স্রেফ একটু ভালো গন্ধ আর রূপের জন্য এমন বোকার মতো কেউ বয়ে নিয়ে যায়?

মেয়েটা সে অধুনাবিস্মৃত ভাষায় ঠেস কথা কানে নিতো না।
ছাল ছাড়িয়ে মাংসের টুকরোগুলো ঝলসে ভাগ করার কাজ শেষ হলে,
আকাশের ছড়িয়ে থাকা এত এত জ্বলন্ত ফুলকির মাঝে
সাদাপানা যে গোলাটা রোজ কমে বাড়ে,
তারই আলোয় ,
গুহা থেকে কিছুদূরে তিরতিরে নদীটার পাড়ে বসে মেয়েটা সে ফুলগুলো দিতো এক আদিম যুবকের হাতে।
যুবকটি হেসে ফেলে প্রশ্ন শুধাতো,
খাওয়া যায় না,
পাথর বাঁধা যায় না,
এই বেকার ফুলগুলি আমায় দিচ্ছিস কেন ?
মেয়েটা সেই আকাশের ফুলকিগুলোর দিকে তাকিয়ে উদাস স্বরে জবাব দিতো ‘ এমনি’।

একদিন, ছেলেটা শিকারে গিয়ে আর ফিরলো না।
খাঁড়াদাঁত বাঘে খেলো নাকি মারা গেলো কোনো ম্যামথের শুঁড়ে, সেটা অবান্তর।
মেয়েটা কয়েকটা দিন গুম হয়ে বসে রইলো,
তারপর একরাতে,
আকাশের সাদা আলোর গোলাটা যখন সকালের লাল গোলাটার মতো পুরো গোল,
দিনের মতো সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে
গুহা থেকে নদীতীর অবধি সব কটা গাছ ও পাথর,
সেসময়,
নিভু নিভু আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা
মায়াবী  স্বরে ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো আশ্চর্য কিছু কথা,
যা শুনে তার সঙ্গী সাথীরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো,
সকলের চোখ কেন যেন ভরে গেলো স্মৃতির অশ্রুতে।

মেয়েটা থামলে বুড়ি সর্দারনি বললো ‘ আবার বল’
মেয়েটা বলেই চললো ,
বুনো ফুলেদের কথা,
আকাশের সাদা গোলা আর ধীরে বওয়া নদীটির কথা,
শিকার আর ঝলসানো মাংস খাওয়ার কথা,
আর সবকটা কথার পুঁতি নিহত সাথীর বিরহের সুতোয় জুড়ে তৈরি করলো এক নিটোল মালা,
এর আগে এই পৃথিবীতে কখনো শোনা যায়নি তা।

সর্দারনি মায়াচ্ছন্ন গলায় বললো,
‘ আমি এর নাম দিলাম কবিতা।’

আর্যতীর্থ