। জনক।
                           । ১।

২৭ শে জানুয়ারি বাড়ি ফেরবার পথে, থমথমে সন্ধে নেমেছে,
অকালবৃষ্টি নেমে চারিদিকে থিতু নির্জনতা, শীতও কিছুটা বেড়েছে,
যথারীতি ছাতা সাথে নেই, তাই পা চালিয়ে হাঁটি,
আবার বৃষ্টি এলে দেরি হয়ে যাবে , খবরটা দেখা হবে মাটি।
সে আশায় ছাই দিয়ে ঝমঝম করে মেঘ কাঁদলো আবার,
শীতের অন্ধকারে গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা ভালো লাগে কার,
তড়িঘড়ি এপাশে ওপাশে কোনো আশ্রয় খুঁজি।
ওই তো.. জীর্ণ পুরনো বাড়ি, তবে ছাদ আছে, আপাতত সেখানেই দেহটাকে গুঁজি।
                                   ।২।

দরজাটা ভাঙা, মোবাইলে টর্চ জ্বেলে ঢুকে পড়ি ঘরের ভেতরে ,
আলো পড়ে একখানা নেড়ি ওঠে মৃদু ঘেউ ঘেউ করে,
হয়তো ওটার এখানে ঠিকানা পার্মানেন্ট, আমি বহিরাগত,
তবু কুকুরেরা সীমান্ত অতটা বোঝে না। আমি যে স্বাগত,
ল্যাজ নাড়া দেখে বুঝি। বাইরে বর্ষা ক্রমে হচ্ছে জোরালো,
হঠাৎই চোখটা গেলো ডাইনের দিকে। একখানা ঘর থেকে আলো,
চাপাস্বর ভেসে আসে, কারা যেন দেশ নিয়ে করে আলোচনা।
কেউ কি আছেন? হাঁকি গলা খাকরিয়ে করে দোনামনা,
অন্তত জানানো দরকার আশ্রয় হয়েছে নিতে নিরুপায় হয়ে।
‘ভেতরে এসো বাবা’..ক্ষীণ আহ্বানখানি নিয়ে এলো যেই স্বর বয়ে,
যেন বহুকাল ধরে চেনা। মা ঠিক এরকমই যেন..
ধ্যাত্তেরি, সে মহিলা কবেই তো চলে গেছে ছেড়ে, এখনো যে তবু এত হাহাকার কেন!
                                    । ৩।

ঘরে ঢুকলাম। আলোটা যে কোত্থেকে বোঝা যাচ্ছে না,
যেন কেউ পূর্ণিমা রেখে গেছে ঘরে। বাইরে বৃষ্টি আর ভেতরে জোছনা,
সে আজব ব্যাপারের চেয়ে অদ্ভুত, ঘরখানা জনহীন, খাঁ খাঁ
টেবিলে পুরনো বই,  বাঁশের লাঠিতে লাগা ভারতের তেরঙা পতাকা,
একটু মলিন হওয়া প্যারিস প্লাস্টারের অশোক স্তম্ভ একখানা কোনে,
একটা দেওয়াল জুড়ে ভারতের ম্যাপ। আমি টর্চ জ্বালি ফের ফোনে,
কই কেউ নেই ! কে ডাকলো তবে? ব্যাপারস্যাপার মোটে লাগছে না ঠিক,
পিছু ফিরতেই সেই স্নেহময় স্বর,  ‘এসেছো যখন তবে বসো নাগরিক।’
কে বলে? স্বর দেখি ভেসে আসে ভারতের মানচিত্র থেকে, আলোর উৎস ওই বই,
পতাকাটা দুম করে সটান আর খাড়া। অশোক স্তম্ভ বলে ‘প্রশ্নটা করো ওকে , সই! ‘
করবো, একটু ধাতস্থ হোক! ও এখনো ভাবছে বোধহয় সব কাণ্ড ভুতুড়ে,
মানচিত্র বলে । পতাকা রয়েছে খাড়া কিঞ্চিৎ দূরে,
পালাতে গেলেই ঠিক  আগলাবে  পথ,  এ কার  ম্যাজিক! হঠাৎই আশিরনখ শিহরণ জাগে,
ম্যাপটা আমার চেনা ভারতের নয়। প্রদেশের সংখ্যাটা বড় কম লাগে।
                                                 ।    ৪।

‘উনি প্রথম সংবিধান, আমি প্রথম ম্যাপ, অশোক আর ত্রিবর্ণ বদলায় নি,’
বলে ওঠেন মানচিত্র, গলায় মমতা ঠিক মা যেন আমার। ‘তোমাদের সমকাল আমাদের ঋণী,
যদিও ইদানিং নথিতে আমরা লঘু ,ব্যক্তির ছবি জ্বলজ্বলে,
তবুও আমরা আছি, আপাতত ইতিহাস না বদলে যতদিন চলে।
তোমাকে একটা প্রশ্ন করি উত্তর-নাগরিক, জানি জবাবটা তার সোজা ভাবে লোক,
তবু নিশ্চিত , তারা পুরোটা জানে না। বলো দেখি, গান্ধীজী কেন এই জাতির জনক?’
                                     ।  ৫।

ইতিহাসে ছেচল্লিশ ছিলো মাধ্যমিকে। কুঁতিয়ে বললাম ‘ওই তো অহিংস অসহযোগ ,ভারত ছাড়ো, সবাই জানে যেসব কথা
মানে ভীষণ  বড় নেতা তো তাই। ওঁরা হো হো হেসে বললেন, বেয়াল্লিশের আন্দোলনে সাতচল্লিশে এলো স্বাধীনতা,
সেরকম ভাবো বুঝি? গান্ধী একাকী নন, ওদিকে সুভাষের ফৌজ, এইদিকে ক্রমাগত প্রজা অসন্তোষ,
ওরা বুঝেছিলো না দিলে কপালে দুঃখ আছে। যাওয়ার আগে তাই করা শেষ ফোঁস,
দেশের মাঝখান গিয়ে রাডক্লিফ তরোয়াল কেটে দিয়ে গেলো বরাবরের মতো শান্তিকে ,
বলি স্বাধীনতা পাওয়াটাই যদি পিতৃত্বের কারণ, এতটা বিদ্বেষে কেন দেখে তাঁকে সীমানার ওইদিকে?’
আমি ভাবলাম, সত্যিই তো, পাকিস্তানে তাঁর  কোনো মূর্তি নেই প্রকাশ্য স্থানে
একবার গুগলে দেখেছিলাম ।  মৌলবাদের  অসহযোগের কাছে কবেই হারিয়ে গিয়েছে অহিংসার মানে।

                                      ।৬।

বাইরে শীতের বৃষ্টি, পোড়ো এক ঘরে অলৌকিক আলো আর চারখানা জীয়ন্ত জড়,
যাঁরা স্বাধীনতার প্রথম প্রতীক। হয়তো বা ভৌতিক,  তবু ভয় কেটে গেছে , বিশ্বাস করো,
শুধু এক সম্ভ্রমমিশ্রিত কৌতুহল জেগে আছে। জ্ঞানের অভাব স্বীকার করে নিই করজোড়ে,
তারপরে বলি, ‘বলুন,  শুনতে চাই, মহাত্মার থেকে তিনি জাতির পিতা হলেন কেমন করে।’
এতক্ষণে বই কথা বলেন, সংবিধানের প্রথম ও আদি সংস্করণ,
‘তোমাকে বলবেন ওই মানচিত্র-মা। আমারও  জন্ম জেনো হয়নি তখন।’
                                               । ৭।

‘আগস্ট ১৯৪৭ ..’ মানচিত্র কেঁদে ওঠেন বলে। সীমান্তের রেখা বেয়ে হঠাৎ পড়তে থাকে রক্ত ঝরঝর
রক্তের অক্ষরে ফুটে উঠতে থাকে নাম.. কলকাতা, লাহোর, করাচি, দিল্লী, অমৃতসর,
‘ওপারে  হিন্দু শিখ, এপারে মুসলমান মরে শয়ে শয়ে, প্রথমে দুটো দেশে একই হিংস্রতা,
বাপু বসলেন অনশনে ।দাবী তাঁর অন্তত ভারতে ফিরুক শান্তি।
পদতলে অস্ত্র নামিয়ে থেমে গেলো কলকাতা।
দিল্লী তখনও নরক, দলে দলে শিখ আর হিন্দু রিফিউজিরা সঙ্গে আনছে বয়ে বীভৎস ক্ষত,
যার খেসারত দেয় এই দেশে থেকে যাওয়া মুসলিমরা। ধর্ষণ খুন আর লুণ্ঠন চলে ঠিক লাহোর করাচির মতো,
এ সুযোগে  আর এস এস আর মহাসভা জানাচ্ছে দাবী দেশ হিন্দু ও শিখেরই হতে হবে,
কংগ্রেসে সেই ঢেউ আছড়িয়ে পড়ে। সেকুলার রাষ্ট্রের স্বপ্ন বিনষ্ট হয় বুঝি শৈশবে,
ঠিক তখনই, নরকের মধ্য থেকে একটি স্বর্গীয় স্বর দৃঢ়সংকল্পে এক বার্তা পাঠান,
‘যতদিন হিন্দু মুসলিম শিখ ফিরে আসে সহাবস্থানে, ততদিন অনশন। দরকারে গেলে যাক প্রাণ।’

                                           । ৮।

স্তম্ভিত আমি শুনছি শুধু , সাতচল্লিশ আটচল্লিশ সালে ক্ষীণজীবি বৃদ্ধের অটল লড়াই,
‘ ওইপারে যা হচ্ছে তার বদলা নেওয়া না। নতুন এ ভারতে সব ধর্মকে আমি পাশাপাশি চাই’
সেই আহ্বান শুনে সম্বিত ফিরে পায় একখানা দেশ। ওপারে হিংসা যখন আরো দাউ দাউ জ্বলে,
এপারে শান্তি নামে।  তখনও অস্থায়ী সে, জানিনা থাকতো কতদিন ওইভাবে বাপুজীর মৃত্যু না হলে!’
‘মানে? ‘ মহাবিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করি আমি, ‘নাথুরামের গুলি না চললে ওই হিংস্রতাতেই  ফিরে যেতো দেশ?’
মানচিত্র কথা বলে কান্নার মতো স্বরে, ‘ তাঁর ওই শবদেহ প্রমাণ যে করে গেলো কোনখানে মানুষকে নিয়ে নেয় বিদ্বেষ।
হিন্দুরাষ্ট্রের দাবী মন থেকে মুছে গিয়ে বাপুর স্বপ্নকে সারা দেশ করলো স্বীকার অবশেষে আরো একবার,
ওই সংবিধানের জন্ম হলো তার পরের বছরে । ২৪শে নভেম্বর , ১৯৪৯, পৃথিবী জানলো এই দেশ সেকুলার।’

                                         । ৯।

কম্পিত স্বরে বলি, তার মানে এই যে ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এত কথা,
এত গর্বিত উচ্ছাস,
এ সবের পেছনে একখানা মানুষের জেদ, ভিত গড়ে দিয়ে গেছে সে মহান লাশ?
প্রাকস্বাধীনতা নয়, বরঞ্চ পরে তাঁর অমৃতে বাঁচে দেশ, যদিও নিজের ভাগে জুটেছিলো বিষ..
চারজন প্রতীকই একসাথে বলে, ‘তিনি না থাকলে সেকুলার থেকে দেশ দূরে নিয়ে চলে যেতো সাতচল্লিশ।’

                                         ।১০।

হঠাৎই ঘেউউউউ ডাকে তন্দ্রাটা কাটে। কুকুরটা ডাকছে, কখন ঘুমিয়ে গেছি , বুঝিইনি সেটা,
বাইরে বৃষ্টি থেমে হিমেল আঁধার। পোড়োবাড়িটার থেকে বেড়িয়ে বাড়ির পানে লাগাচ্ছি হাঁটা,
হঠাৎই চলতি গাড়ি আলো ফেলে গেলো সেই বাড়ির দেওয়ালটাতে,
চমকিয়ে দেখি অপটু হাতের বেশ বড়সড়  এক ছবি আঁকা তাতে।

বোধহয় ২৬ জানুয়ারি উপলক্ষ্যেই। গান্ধীজী হাঁটছেন, সাথে লাঠি নয়,
ত্রিবর্ণ পতাকাকে তুলে দুই হাতে।

আর্যতীর্থ