। চাবিগোছা।

বুড়ো বটগাছ এইবারে রাখবেন দেহ। পাতায় পাতায় তাঁর ক্ষয় চিহ্নিত,
হৃদ-ধুকপুক বড় অনিয়মিত, ক্রমশ ওষুধের নিয়ন্ত্রণহীন,
ডালে ডালে ফাটা বল্কল,
সোডিয়াম ওঠে নামে, বৃক্কে ফাটল,
একদা আশ্রয় হওয়া আকাশমাফিক বুকে
ফুসফুস ঠেলে ঠুলে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে পারছে না আর,
রাইলস টিউব দিয়ে কত আর পৌঁছাবে শেকড়ে খাবার,
সপ্তাহ , দিন কমে আয়ুর এখন স্থিতি ঘন্টা হিসেবে,
মনিটার গ্রাফগুলো এই বুঝি নেভে।

গাছের নিয়ম মেনে এই গাছে বেশকটা ঝুরি।
গাছ-ব্যাকরণ ভেঙে অবশ্য তারা কেউ
আশেপাশে নেই ছায়া বেঁটে নিতে,
সকলেই ভিন্ন শহরে, দুইজন চলে গেছে দেশের সীমানা ভেঙে প্রবাসী মাটিতে,
পরিমিত সার জলে পুষ্টি যথেষ্ট জমে তারা আজ পরিচিত বৃক্ষ হয়েছে প্রদেশে বিদেশে,
পরের ঝুরিরা ক্রমে পাতা ডাল পালা বের করে, আলগা শেকড়ে কোন ভুঁইয়ে যাবে ভেসে ,
সেসব আগামী জানে,
আপাতত সব ঝুরি আসন্ন বিয়োগের শোকে জুটেছে যে পুরনো ভিটেতে,
ফিরি সেইখানে।

এখানে প্রপার্টি নিয়ে মারামারি নেই, সকলে তৃপ্ত বেশ নিজেদের নিয়ে,
ছোটোবেলা কৈশোর কিছুদূর যৌবন স্মৃতিরা দিচ্ছে ফিরিয়ে,
অচিরেই এসে গেলো শোকসংবাদ,
বটগাছ থেকে ঝরে গেছে শেষ পাতা, বাসা ছেড়ে উড়ে চলে গেছে শেষ পাখি,
সময়ের রোলকলে একজন বাদ।
সকলেই জানুক যতই, তবুও বিষাদ আসে সুনামির মতো,
আগে থেকে টের পেলে ক্ষয়ক্ষতি কম করা সম্ভব না তো,
থমকানো কান্নারা থমথমে পরিবেশ
আরো যেন করে রাখে ভারী।

সব কাজ শেষ হলে, বটগাছ-চারাগুলো একদিন খুলে দেখে তাঁর আলমারি,
সেখানে সাজানো আছে ছোটোবেলা থেকে পাওয়া কত সব ভুলে যাওয়া মণি,
প্রাইমারি মার্কশিট, চামচ-গুলির রেসে থার্ড প্রাইজ ঝাপসা মেডেল,
স্কুলের ডিবেট আর পাড়ার আবৃ্ত্তিতে পাওয়া বই.. সবই আগলে ছিলো সে স্নেহের খনি,
ছোটোবেলা-প্রহরীর থেকে শেষ উপহার পায় সকলে এক এক করে,
বহুদিন আগে যারা স্মৃতি থেকে মোছা।
হঠাৎই নজর পড়ে, দেরাজের এক কোণে ছোট এক ব্যাগে ভরা মোটা চাবিগোছা।

কী কী খোলে চাবিগুলো দিয়ে? সেটা কারো জানা নেই,
বহুদিন সে চারারা আসেনি বাড়িতে,
যিনি নেই, তিনি শুধু পারতেন সমাধান দিতে।
কাজেই সকলে মিলে এক একটা ঘরে যায়, কোনোখানে আলমারি, কোথাও তোরঙ্গ খোলে,
ছোটো হয়ে যাওয়া ফ্রক আর হাফ প্যান্ট, লাট্টু লাটাই আর মার্বেল গুলি কোনোখানে মেলে,
কোথাও মায়ের শাড়ি, সাদাকালো অ্যালবাম, ম্যাড়ম্যাড়ে পোস্টকার্ড.. শ্রীচরণেষু বাবা দিয়ে শুরু লেখা সবই,
ছোটোবেলা ফিরে যেতে কম্পাস-কাঁটা যেন দিক বলে দেয়,
ক্রমশই রঙ পড়ে গাঢ়,  আরো গাঢ় হয় ছবি,
আলগা সুতোর এই আধুনিক পৃথিবীতে ঝুরিগুলো ঘেঁষে আসে পরস্পরের দিকে আরো বেশি করে,
‘ বেঁধে বেঁধে থাকবি বাছারা, নয়তো শেকড় হবে খুব নড়বড়ে’
সকলে শুনতে পায় নিজেদের মনের ভেতরে।

সদ্য বাঁধানো ফটো হাসিমুখে দেখে। হাওয়া নেই, তাও যেন মালা ওঠে নড়ে।

আর্যতীর্থ