। বাড়ি।

ভবেশবাবুর বাবা দশ বছর বয়সে পার্টিশনের সময় কলকাতা পালিয়ে এসেছিলেন,
এক কাপড়ে।
তারপর সেখানেই পড়াশোনা, চাকরি বিবাহ ও পরিবার পরিকল্পনা।
নিজের চেষ্টায় তৈরি যাদবপুরে একটা দেড়তলা আস্তানাও,
যেখানে ছাদে লাইন দিয়ে জুঁই টগর জবা আর বেলি,
শীতকালে ইয়া বড় বড় ডালিয়া ফুটতো জাদুকরের সবুজ হাত লেগে।

অথচ বাড়ি বললেই ছানি কাটানো দুই চোখে
সূর্যের উজ্জ্বলতা ঢেলে বলতেন
সে আছিলো কোটালিপাড়ার উনশিয়া গ্রামে!
বাঁশের বেড়া,
টালির চাল,
উঠোনে তুলসী-মঞ্চ, কুপির
আলোয় সন্ধ্যার পড়াশোনা
আর পোষা নেড়ি কুকুর পল্টু,
সে সব শুনে শুনে চেনা লোকেদের কান পচে গিয়েছিলো!

সে অনেক আগের কথা।
ভবেশবাবু কলকাতায় থাকেন না বছর পঁয়তিরিশ,
কাজের সূত্রে ব্যাঙ্গালোর এসে এখন ব্যাঙ্গালুরুর স্থায়ী বাসিন্দা।
এয়ারপোর্ট থেকে অল্প দূরে
যে ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সের সাততলায় তার ঠিকানা,
সেখানে গেটে বড় বড় ফক্সটেল পামগাছ.
বর্ষাকালে ঝাপসে পদ্ম হয়ে থাকে ওয়াটার-বডিতে
ওয়াকিং ট্রেলের পাশ ঘেঁষে অজস্র ফুলের গাছ মালির যত্নআত্তিতে সারাবছর ফুল ফোটায়।
তবে গাছ দেখতে হলে ভবেশবাবুর বারান্দায় যেতে হবে,
সেখানে প্রায় তিনশো অর্কিড ঘেঁষাঘেষি করে
একটুকরো জঙ্গল তুলে নিয়ে এসেছে।

তবে বাড়ি জিজ্ঞেস করলেই ভবেশবাবু বলেন,
‘ সে তো ছিলো যাদবপুরে,
দেড়তলা’র ছাদে মা রোজ তুলতো পুজোর ফুল,
এই বড় বড় ডালিয়া ফোটাতো আমার বাবা।
সেই তুলনায় এখানকার গাছ, ছোঃ!

ভবেশবাবুর মেয়ে শালিনী মেধায় সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
স্যাট স্কোর এত বেশি ছিলো,
বারো ক্লাস পেরোতেই আমেরিকা ছিনিয়েছে দেশি ক্ষেতের ফসল,
কোডিংএর দুনিয়ায় নামডাক এত বেশি তার,
সম্প্রতি সে পেয়ে গেছে
অ-আমেরিকা পৃথিবীর স্বপ্ন ছোঁয়ার গ্রীন কার্ড।

জীবন চলে গেলে তিরিশ বছরের পরে,
প্রতিবেশিনী শ্বেত বা কৃষ্ণ বা পীতবর্ণ আমেরিকানকে
সে তার লন পরিষ্কার করতে করতে বলবে,
‘Home? That was in Bangaluru, a varandah full of orchids.. this is nothing compared to that place.’

আর শালিনীর পুত্র অথবা কন্যা,
তাদের আমেরিকান বাড়িটিকে হৃৎমাঝারে নিয়ে
ততদিনে চলে গেছে স্টকহোম বা রিও ডি জেনেরো,
আদ্দিস আবাবা বা মাসকট,

কিংবা কে বলতে পারে, হয়তো কলকাতা অথবা ফরিদপুর..

ছোটোবেলা কাঁধে চেপে আমাদের সঙ্গেই চলে আজীবন,
ঠিকানার থেকে বাড়ি হতে পারে বহু, বহু দূর।

আর্যতীর্থ