লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক।
ইন্নাল হামদা ও’য়ন্নি’মাতা-
লাকা ওয়াল মুল্ক,
লা-শারীকা লাকা লাব্বায়্যিক...
লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক।

বান্দা হাজির, ইয়া মা’বুদ!
তোমার ঘরে তোমার মেহমান হয়ে
তোমার দয়ায় তোমার হুকুম পালন-ব্রতে
একত্ববাদ আর ঐক্যের সুমহান ঘোষণার স্রোতে
জাতি-বর্ণ-গোত্র ভেদ ভুলে অভেদ সুরে...
লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক।

দূর-দূরান্তের বাঁধা পেরিয়ে
কাঁটাতার-সাগর-পাহাড় সমস্ত মাড়িয়ে
প্রেয়সী-সংসার, স্বজন-পরিজন আর
মমতা-মায়া সহস্র পিছুটান দুর্নিবার
সব ভুলে গিয়ে
ছুটে আসা তোমার কাছে,
ঐশ্বরিক টানে তোমার দরবারে মাথা নোয়ায়ে
কেবল জানান দিতে হাজিরায়ে-
লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক।

লাব্বায়্যিক ধ্বনিতে মুখরিত
আরাফাতের এই ময়দান...
সেই ময়দান-
যেখানে দাঁড়িয়ে জগৎ সংসারের শ্রেষ্ঠতম মানুষটি দিয়েছিলেন
শ্রেষ্ঠতম ভাষণ।
যেখানে রেখেছিলেন-
বিশ্বজগতের মুক্তির পথরেখার চূড়ান্ত রুপরেখা।
মিডিয়া কাভারেজহীন লাখো মানুষের সেই মাহফিল থেকে
ঘোষিত হয়েছিল-
জনে জনে সেই ঘোষণা-পাঠ পৌঁছে দেওয়ার অসাধারণ প্রক্রিয়া,
‘তোমরা যারা উপস্থিত তাঁরা পৌঁছে দেবে সেইসব মানুষের কাছে,
যারা আজকের দিনে অনুপস্থিত এখানটায়।’
দেড় সহস্র বর্ষ পেরিয়ে আজকের পৃথিবী সাক্ষী-
মহান মানুষটির পবিত্র মুখ নিঃসৃত সেই বাণী
জনে জনে ঠিক পৌঁছে গেছে।

সেই ময়দান-
যেখানে দাঁড়িয়ে মহান প্রভুর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দার কন্ঠে উঠেছিল
দ্বীন ক্বায়েমের দৃপ্ত আওয়াজ-
‘হে প্রভু! হে মা’বুদ! হে পরওয়ারদিগার!
আমি কি তোমার দাওয়াত সুচারু রুপে
এই ধরণীতলে এই জনপদে এই জন সমাজে
এই মানবমন্ডলীর মাঝে
পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি?’
লাখো কণ্ঠের সমস্বরে জবাব-
‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! নিঃসন্দেহে আপনি পেরেছেন। অবশ্যই পেরেছেন।’
ঊর্ধ্ব আকাশপানে দু’চোখ তুলে তাঁর সাক্ষী নির্ধারণ-
‘হে আল্লাহ! হে প্রভু! আপনি সাক্ষী থাকুন।’
উপস্থিত জনতার ‘ইশারা’ বুঝতে দেরী হয় না মোটেও,
লক্ষ হৃদয়ের আবেগ মথিত কান্না
শোরগোল ফেলা ক্রন্দন রোল...
ভারী হয় ময়দান, ভারী হয় সুবিশাল আকাশ,
ভারী হয় বাতাস-পাহাড়-প্রকৃতি
এ ঘোষণা যে-
সেই ময়দান থেকে সেই মঞ্চ থেকে
শ্রেষ্ঠতম মানুষটির ইহ জগতের ইতি...

আজ সেখানটায় দাঁড়িয়ে
কম্পমান হৃদয় আর কাঁপা কন্ঠে
ঘোষণা-
লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক।

মিনার পথে যাত্রা
মুজদালিফায় রাত্রিবাস
মনের ঝাল মিটিয়ে কঙ্কর নিক্ষেপে শয়তান-নিধন
কালো পাথর চুম্বনের তীব্র আবেগ
ক্বাবার চত্বর ঘিরে তাওয়াফের পর তাওয়াফ
সাফা মারওয়ার সা’য়ী...
সেই সাফা মারওয়া-
যে পথ জুড়ে হন্যে হয়ে ছুটেছিলেন আমাদের পিতা
আমাদের বংশ পরম্পরার পুরুষোত্তম,
ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের পুণ্যবতী স্ত্রী
উম্মাহর পুণ্যবতী নারী,
আমাদের নারীকুলের আদর্শ
মা-বোন-বউ-কন্যা সকলের অনুপ্রেরণা-
হাজেরা আলাইহিস সালাম।
পুত্র ইসমাঈলের তৃষ্ণা নিবারণে
যিনি দিগ্বিদিক হয়ে ছুটতে ছুটতে
ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন,
আর অর্জন করেন মহান প্রভুর সন্তোষ।
সেই স্মৃতিচিহ্ন, সেই ইতিহাস, সেই পূণ্যময় অতীত
আরো একবার পালনে
আপ্লুত কণ্ঠে ছলকে উঠে-
লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক।

হে প্রভু! বান্দা হাজির।
তোমার দাস, তোমার দাসানুদাস উপস্থিত।
শত ডাক, সহস্র টান, অজস্র আকর্ষণ উপেক্ষায়,
শুধু তোমার হুকুম পালনে
কেবল মাত্র তোমার জন্য
তোমার সন্তুষ্টির নিখাঁদ অভিপ্রায়ে
হাজারবর্ষী পুরনো এই আয়োজনে
এই মিলন মেলার মেহমান আজ...
লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক।
*****

মুয়াজ্বিনের আযানে আহবান নিশ্চিত কল্যাণের।
হাইয়্যা আ’লাস স’লাহ, হাইয়্যা আ’লাস স’লাহ
হাইয়্যা আ’লাল ফালাহ, হাইয়্যা আ’লাল ফালাহ
সেই ডাক কর্ণকুহরে অবাক বান আনে।
ছুটে চলা হন্তদন্ত পা’য় মহান প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতে
মি’রাজ লাভের মহান সৌভাগ্যের ছোঁয়া পেতে,
মহান প্রভুর সঙ্গে মহা মিলনের
আর একান্ত সাক্ষাতের
মহা আনন্দময় সময়-উপভোগে।
জায়নামাযে ঠাঁয় দাঁড়ায় অথবা মসজিদের কাতারে
সিজদায় কপাল ঠেকায় বিড়বিড় সুরে
কিংবা সারি সারি কাতারের মিছিল জুড়ে
হাজিরার জোরালো ঘোষণা-
লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক।
*****

বহু পরিশ্রম আর অধ্যবসায়
ত্যাগ তিতিক্ষা আর কত নির্ঘুম রাত্রি পরে
অর্জিত সম্পদ তিলে তিলে
তিল থেকে হয় তাল
বিন্দু বিন্দু জুড়ে গড়ে বৈভব-সম্ভার।  
সেই সম্পদ যবে পেরোয় নিসাব-সীমা...
খাত বুঝে স্বতঃস্ফুর্ত ব্যয় আর-
হক্বদার ডেকে বুঝিয়ে দেয়া যার যার পাওনা।
অর্জিত ধনরাশির আড়াই অংশে প্রশ্নহীন ছাড়
খোদার হুকুম তামিলে আনন্দ অপার
মহান প্রভুর সন্তোষ, আর
সম্পদ পরিশুদ্ধির
সুতীব্র জিগীষা
আচার আচরণে বান্দার আন্তরিক ভাষা,
সুস্পষ্ট ঘোষণা-
লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক।
*****

তীব্র গরম, ইবলিসের নানান ফাঁদ
চলার পথে কত না বাঁক!
যাতনা কত, বিদ্রুপ-টিটকারি মহামারী
তবু প্রভুর পথে সত্য স্রোতে
নিশ্চল যাত্রা,
নিশ্চিত বিধান মানার স্থির-ব্রতে
সুনির্ধারিত আইনে
বান্দার নিজেকে মোড়ানো
আগাগোড়া ঢেকে প্রভুর পছন্দ মতে সাজানো,
বিন্দুমাত্র ছাড় নেই প্রভুর ব্যাপারে
প্রভুর আদেশ মানায়;
পর্দা নিয়ে নয় কোনো হেলাফেলা,
বোরখা-নিকাব কিংবা দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ
সবটাতেই আস্ত ঘোষণা-
মহান রবের বান্দা, আর প্রভুর প্রতি বান্দার ভালোবাসা।
হে মা’বুদ!
তোমার বিধান, তোমার আইন, তোমার কানুন,
তোমার আদেশ, তোমার নিষেধ,
তোমার নির্দেশ পালনে...
লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক।
*****

গ্রীষ্মের খেজুর পাকা ঘ্রাণে মৌ মৌ
মৌতাত বাতাস জুড়ে পাকা টসটসে ফলের।
লোভনীয় খাবারের আঘ্রাণে
জিহ্বার নাড়াচাড়া আর জেগে উঠা নানান স্বাদ আস্বাদনে,
সেইসব ভুলে সেইসব ফেলে
ছুটে যাওয়া দ্বিধাহীন,
যদি ডাক আসে মহান কর্তব্যের।
স্ত্রী-সোহাগ, আদরের সন্তান, সংসার-মায়া
সমস্ত এক নিমেষে ছুঁড়ে
ব্যবসাপাতি-চাকরি-জীবিকা সমস্ত ছেড়ে,
এক আল্লাহর একত্ব ঘোষণায়
প্রয়োজন যদি হয় তুলে নিতে তলোয়াড়
কিংবা বুলেট-চাবুক, তীর-ধনুক যা-হোক কিছু
দেরী নেই তাতে, নেই দ্বিধা-সংশয়।
সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সমরে
মিথ্যার নির্মূল লক্ষ্যে
সুতীব্র বেগে একত্ববাদ-আবেগে
ছুটে যাওয়া জিহাদের ময়দান,
মুসলমানিত্বের চরম পরীক্ষায় উতরে গিয়ে
দাসত্বের পরম মাত্রা ছুঁয়ে
মহান রাজাধিরাজ! তোমাকে জানিয়ে দেয়া...
লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক।
*****

ইন্না স’লাতী ও’নুসুকী ও’মাহঈয়া’ঈয়া ও’মামা’তী...
লিল্লাহী রাব্বীল আ’লামীন।
আমার সমস্তই আপনার জন্য, হে প্রভু।
হে মা’বুদ!
আমার নামায, রোযা, হাজ্ব, যাকাত
আমার কুরবানী, ইবাদাত
আমার তিলাওয়াত
আমার জীবন-মরণ
সব, সব আপনার জন্য।
বিশ্বজগতের হে মহান অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাধর!
পুনরুত্থান দিবসের মালিক!
হে মহান রাজাধিরাজ!
বিশ্ব চরাচরের হে মহান অধিপতি!
আমার জীবন-যৌবন-বার্ধক্য,
আমার অধ্যাবসায়-কর্ম-চিন্তা-পাঠ-আলেখ্য,
সমস্তই হোক, আপনার জন্য।
হে মা’বুদ!
ইবাদাতের একচ্ছত্র দাবীদার হে!
আমরা আপনারই ইবাদাত করি,
গোলামী করি আপনার।
আপনার দাসত্ব আর বন্দেগীই
সুনির্দিষ্ট, সুনির্ধারিত।

হে পরওয়ারদিগার! হে মালিক! হে মহান বাদশা!
আপনি অসীম, আমরা সসীম।
আমরা তুচ্ছ, ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
আপনি বিরাট, বিশাল, সুমহান-
আপনাকে বোঝা মানবজ্ঞানে অসম্ভব, অসাধ্য।

হে প্রভু! হে মা’বুদ! হে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী!
আপনার কাছেই যাবতীয় প্রার্থনা, একান্ত কামনা-
অবধারিত মৃত্যু আসবে যেদিন,
মৃত্যুদূতের পয়গাম আসবে যখন,
তার আগেই,
হে প্রভু! সেই দিন আর ক্ষণ আসার আগে...
জিন্দেগী এমন করে সাজিয়ে দিন,
যেনো মৃত্যুদূত আর মৃত্যু-
উষ্ণ সম্ভাষণে সম্ভাষিত হয়!
ভয়, আতঙ্ক, থরথর কাঁপুনির বদলে
আপনার সাক্ষাৎ, আপনার পুরষ্কারে
আচ্ছন্ন হওয়ার সুযোগ হয়!

হে মা’বুদ! হে প্রভু! হে মালিক!
হাজিরা ঘোষণার সম্মান নসীব করুন,
ইয়া আল্লাহ।
যে মুহূর্তেই মৃত্যু আসুক,
যেনো পরম আবেগে বলে উঠতে পারি-
লাব্বায়্যিক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়্যিক...।

১১ই আগস্ট, ২০১৯
৯ই যিলহাজ্ব, ১৪৪০