ক্ষুধাতুর দু'টি শিশু,
দাঁড়াইয়া আছে পথের একধারে, ভাবখানি মিশু মিশু।
কিন্তু তাদের সাথে কে মিশিবে, সবে নিজ পথে চলে;
স্নেহে ও আদরে, আবেগ কন্ঠে দু'টি কথা নাহি বলে।
বড়টির বয়স কতই বা হবে - বড়জোর ছয়/সাত,
চলিয়াছে পথ, ছোট ভাইটিরে লইয়া তাহার সাথ।
চলিয়াছে তারা জীবনের পথ, সয়ে হীন অপমান,
মানুষ বোঝে না স্নেহের কাঙাল কোমল সে দু'টি প্রাণ।
কাঁধে ঝুলাইয়া এক ছেঁড়া ঝুলি, ছোট ভাইটিরে কাখে
লইয়া সে ঘোরে দ্বারে দ্বারে, আর ক্ষীণ কন্ঠে সে হাঁকে,
"বাড়ির কর্তা দেহ মোরে কিছু, দু' পয়সা ভিখ্ মাগি।"
ক্ষুধার জ্বালায় কত দিন গেছে, কত রাত গেছে জাগি'।
কেউ বা দু' টাকা দিয়ে দেয় হাতে, কেউ বা কিছু না দেয়,
বুকের দুঃখ গড়াইয়া নামে শ্রাবণের ধারা ন্যায়।
বাবা নাই তার। অনেক আগে মরে গেছে, বহুদিন।
সে দুঃখ তাই মনে তার নাই, ছিল নাকো তারা দীন।
বিধবা জননী কাজ করে কিছু অর্থ জোগাড় করে
খাদ্য জুটাতো। মাতা-পুত্ররা খেত সবে পেট ভরে।
হয়তো বা পেট ভরতো কখনো, কখনে বা আধপেটা,
কখনো বা খেত ক্ষুধার জ্বালায় পথে-ঘাটে পেত যেটা।
রাত্রে ঘুমাতো মায়ের বুকে সুখে তারা দুই ভাই,
ভাবিত তাদের মত এত সুখী এ জগতে বুঝি নাই।
পাখীর ছানা মা'র ডানাতলে আঁকড়িয়া শুয়ে থাকে,
তারা সে-পাখীর ছানার মতন নয়নে স্বপন আঁকে।
তা-ই দিয়ে তারা সুখী ছিল খুব, দুখ ছিল নাকো কভু,
যদিও বস্ত্র জোটে নাই শীতে, কাঁটা দিয়ে ওঠে, তবু।
যদিও জোটেনি লেপ, কাঁথা শীতে, গরমে জোটেনি পাখা,
মায়ের হস্তে স্নেহ, সুধা ছিল, ছিল সে আদর মাখা।
একদিন তার মা'র হলো জ্বর, শয্যা সে নিল হায়,
দু'টি সন্তান পাশে বসে তার কাঁদিয়া অকূলে চায়।
ওষুধ, পথ‌্য কিছুই জোটেনি সেদিন তার অসুখে।
চোখ বুঁজলো সে তাদের রাখিয়া অন্ধকারের বুকে।
মা'র বুকে সে যে ঝাঁপাইয়া পড়ি কাঁদিল আকুল সুরে,
বুক-ফাটা সেই কান্নার সুর বাজেনি মৃত্যুপুরে।
কে আর তাদের বুকে নিয়ে বল ঘুমাবে সারাটি রাত,
আদর করিয়া সমস্ত দেহে বুলাবে কোমল হাত?
ছোট ভাইটি যে মায়ের বুকের দুধও ছাড়েনি হায়,
কাঁদিয়া কাঁদিয়া নয়নের জলে বুক যে ভাসিয়া যায়।
মাকে খুঁজে ফিরে ছোট ভাইটি যে, তবুও পায় না মা'রে,
যার কোলে যায়, সে মুখ না পায়, কাঁদিয়া সে কোল ছাড়ে।
কে আজ তাদের সান্ত্বনা দেবে চরম দুখের রাতে,
মাকে নিয়ে যায়, বুক ফাটে হায়, "মোরে নিয়ে চল সাথে।"
চির দুখী হলো; ছোট ভাই ছাড়া কেউ যে আপন নহে
এ জগতে হায়। দয়া তারা চায়, দুঃখ তাদের দহে।
আজ মনে পড়ে মা'র স্মৃতিখানি, দুখিনী মায়ের মুখ,
চোখে আসে জল, করে টলমল, ভেঙ্গে আসে ঐ বুক।
মা'র মত কেউ আদর না করে, খবর রাখে না কেউ,
কত স্মৃতি এসে ভীড় করে বুকে, কত স্বপ্নের ঢেউ।
পথেঘাটে শুয়ে কাটায় রাত্রি, কোথায় পড়িয়া থাকে,
মা আজ থাকিলে এমন পীড়ন পোহাতে কি হতো তাকে?
মা'র মত কেউ আদর না করে স্নেহ মমতার ভুজে,
ছোট ভাইটি যে ব্যাকুল নয়নে হারানো মায়েরে খুঁজে।
একবেলা কভু খাওয়া জোটে, কভু সারাদিন নাহি জোটে,
ক্ষুধার জ্বালায় নয়নে তাদের করুণ ছায়াটি ফোটে।
চারিদিকে চায় কান্নাভেজা, করুণ, কাতর চোখে,
নিঠুর ধরার বক্ষে তাহারা আপন দুঃখ লেখে।
মা ছিল তাদের প্রখর রৌদ্রে মাথার ওপরে ছায়া,
আদর, সোহাগে স্নেহশীলা মা'র বুকে অকৃত্রিম মায়া।
মুখে নাই হাসি আজিকে দু' চোখ বাহিয়া কান্না ছাড়া,
ব্যথিত বক্ষে দুখ লয়ে ফিরে, ওরা যে মাতৃহারা!

২০-০৫-১৯৮৯