হে বাংলার জনতা
আমি শহীদ রফিক বলছি
পুরো নাম রফিকউদ্দিন আহমদ
যাকে তোমরা ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছ
যার নামে রফিকনগর, গ্রন্থাগার, স্মৃতি জাদুঘর
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রফিক ভবন নামকরণ করেছ
আমার সহযোদ্ধা শহীদ সালাম-বরকত-জাব্বার প্রমুখদের
জিইয়ে রাখতে এমনি অনেক কিছু গড়ে তুলেছ।
শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছর শহীদ মিনারে ফুলেল ট্রিবিউট জানাচ্ছ
অবশ্য শহীদ দিবসে শ্রদ্ধা জানানোর বিপরীতে
তোমাদের এক ধরনের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা দেখি
কোথাও কোথাও তোমাদের মতবিরুদ্ধরা এ প্রতিযোগিতায় নিষিদ্ধ থাকে
আবার কোথাও শহীদ বেদিতে রক্তমাখা গোলাপ-রজনীগন্ধার পাপড়ি ঝরে পড়ে
যেমনটি আমরা ৫২ তে পাক-পিশাচদের গুলি বর্ষণে ছিটকে পড়েছিলাম।
আরও দেখি যে ভাষার জন্য, নয় বছরের শিশু ওহিউল্লাহও অকাল প্রয়াণে শামিল হয়েছে
সে ভাষায় তোমরা মিথ্যা মামলা, পক্ষপাততুষ্ট রায়, বৈষম্যের প্রজ্ঞাপন জারি করছ
যে ভাষায় নজরুল-সুকান্তের পুনর্জন্ম হওয়ার কথা
সেখানে কলম কেড়ে নিয়ে তাদেরকে গলাটিপে হত্যা করেছ।
তবে অবাক হই, তোমাদের মাঝে এখনো প্রেমের প্রকাশ দেখে
যদিও সেটা মানবপ্রেম নয়, ব্যাক্তিপ্রেম
যে প্রেম-পূজোয় বাংলায় আবার রক্ত-পিপাসু তৈরি করছ।
যদি এমনি তোমাদের প্রয়াস
তবে আসছে বছর শহীদ দিবসে
এরূপ মেকি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদেরকে আর ক্ষত-বিক্ষত করোনা।

হে বাংলার জনতা
আমি শহীদ মোস্তফা বলছি
পুরো নাম গোলাম মোস্তফা
যে ৬২ তে শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার মিছিলে লাশ হয়ে ঘরে ফিরেছে
ঐদিন শহীদ বাবুল-ওয়াজীউল্লাহ-সুন্দর আলীরাও
রক্তগঙ্গায় ভেসে বলেছিল, শরীফ কমিশন তুমি আমাদের প্রাণ নিতে পারো
কিন্তু তোমার অন্যায় আবদার হাসিল করতে পারবেনা।
তোমরা আজ অবশ্য আমাদের স্মরণে শিক্ষা দিবস পালন করো
কিন্তু শিক্ষা-ব্যবস্থায় সাম্যের ভিত না গড়ে
নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে, জাতিকে যুগের পর যুগ পিছিয়ে দিচ্ছ।
যদি তোমাদের মনে এখনো মীর জাফর-আইয়ুব খানরা বাস করে
তাহলে আমাদেরকে শহীদ বলে উপহাস করো না।

হে বাংলার জনতা
আমি শহীদ মনু মিয়া বলছি
পুরো নাম ফখরুদ দৌলা মনু মিয়া
যে ৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলনের শহীদদের একজন
যার নামে তোমরা মনু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় বানিয়েছ
আপসোস! এ বিদ্যাপীঠের ছাত্র-ছাত্রীরা আজও বিপ্লবে বিপ্লবে স্লোগান দেয়
জীবন দিতে রাজপথে নেমে আসে, ঘষেটি বেগম-ইয়াহিয়া খানদের রুখতে।
যদি তোমাদের শিরা-উপশিরায় এখনো “মিথ্যার জুজু”
তাহলে শহীদ শফিক-শামসুল হকদের মতো আর কাউকে ডেকে বলোনা, “এটা আমাদের বাঁচার দাবি” -প্লাকার্ডটি উঁচিয়ে ধরো।


হে বাংলার জনতা
আমি শহীদ আসাদ বলছি
পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান
যাকে তোমরা ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের পথিকৃৎ বলে অভিহিত করেছ
যার নামে কবি শামসুর রাহমান ‘আসাদের শার্ট’ নামে কবিতা রচনা করেন
কবি হেলাল হাফিজ তার ক্রোধ-ক্ষোভ প্রকাশ করেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়” কবিতায়।
আমাকে শ্রদ্ধা জানাতে তোমরা কমতি রাখোনি
নামকরণ করেছো আসাদ গেট, আসাদ পার্ক, গ্রন্থাগার, শহীদ আসাদ কলেজ
তবে কেন আসাদ পার্কে এখনো গুম হওয়া সন্তানের জননী তোমাদের ভয়ে
রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদে?
কেন আসাদ গেটের সামনে এখনো ছাত্র-জনতা মাথায় প্রাণের পতাকা বেঁধে
তোমাদের লোভ-লালসার বিরুদ্ধে জড়ো হয়?
পরিণামে শহীদ রুস্তম-মতিউরদের সারি লম্বা হয়।
যদি তাই হওয়ার ছিল,
তবে বিপ্লবের নামে আমাদেরকে ডেকে হত্যা করে
রাতের বেলা চকচকে কাচের গ্লাসে সুরা গিলে
সূর্যোদয়ে আমাদেরকে শহীদ বলে কেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছ?

হে বাংলার জনতা
আমি শহীদ শংকু বলছি
পুরো নাম শংকু সমজদার
৩ মার্চ, ১৯৭১ পাক-স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে ডাকা বিক্ষোভ মিছিলে
মাত্র ১২ বছর বয়সে আমার জীবন নিভে গেল
তোমরা আমাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিলে
আমার নিবাস রংপুরে শহীদ শংকু স্মৃতি সংসদ ও বিদ্যানিকেতন গড়ে তুললে
আমি সেই শংকু যার মৃত্যুতে রংপুর হতে সারা দেশে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হলো
আমার প্রয়াণ মাসে স্বাধীনতার ডাক আসলো
তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত দরিয়া পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্তির আলো পেলো।
আর তোমরা আজ সে বাংলাদেশের জমিনে লালগালিছা বিছিয়ে
গুম-খুন-লুটতরাজের আখড়া পেতে
দিন-দুপুরে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে, বাংলার মাকে তার ক্ষত-বিক্ষত ছেলের লাশ উপহার দিলে
দেশসেরা বিদ্যাপীঠে আবরারকে রূহ কবজ অবধি পিটিয়ে মারলে
তোমাদের হায়েনাদের থাবায় তনু গত হলো আট বছর
এখনো বিচার দূরে থাক, তাদের পরিচয় অজ্ঞাত।
আর তোমরা প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবসে
অভিনয়ের রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ছ
আমাদেরকে স্মরণ করার, দেশকে ভালবাসার, নতুন বাংলাদেশ গড়ার।
হায়! আর কত রক্তের পেয়ালা গলাধঃকরণ করলে
তোমাদের দাঁতাল শুয়োরদের রক্তপিপাসা মিটবে?

হে বাংলার জনতা
আমি শহীদ জেহাদ বলছি
পুরো নাম নাজির উদ্দিন জেহাদ
৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ
যে অভ্যুত্থানে শহীদ নুর হোসেন বুকে-পিঠে
“স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” লিখে
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জীবন বিলিয়ে দিলো
আপসোস! তোমরা যারা ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছ
তাদের আপাদমস্তকে ফ্যাসিস্ট এর এমন দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে
তা শুকে ৯০ এর শূকররাও নিজেদের বর্ণ-পরিচয় ভুলে যেত।
যদি তোমাদের মগজে এ পশুত্ব আজও সাইরেন বাজায়
মিনতি, বিপ্লবের নামে তোমাদের এ বিলাসিতায়
শহীদ জাফর-জয়নাল-দীপালীদের আর স্মরণ করোনা।

হে বাংলার জনতা
আমি শহীদ আবু সাঈদ বলছি
পরিবারের আদরের কনিষ্ঠ সন্তান
২৪ এর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ
যার মৃত্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়্
যে অভ্যুত্থানে শহীদ মুগ্ধ চোখে টিয়ার শেলের তীব্র জ্বালা উপেক্ষা করে
“পানি লাগবে পানি” বলে মানবতার ধর্মে ব্রত হয়ে জীবন বিলিয়ে দিলো।
যে অভ্যুত্থানে চার বছরের শিশু আহাদ, ছয় বছরের রিয়ার দেহ
বৈষম্য বুঝার আগে, তোমাদের বুলেটের বিষাক্ত সীসায় নীল হয়ে গেলো।
আরো ঝরলো হাজারো প্রাণ, স্বপ্ন হারালো অজস্র পরিবার।
এত হারানোর দীর্ঘ পথ পেরিয়েও কি তোমরা মানুষ হয়েছো?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করো তুমি-তোমরা মানুষ কিনা?
নাকি তোমাদের মননে-মগজে এখনো নরখেকোদের আনাগোনা?
যদি তাই হয়, তবে এবার ক্ষান্ত হও
নয়তো যেদিন বাংলার ক্ষমাশীল মায়ের দুহাত ঊর্ধ্বে উঠবে
তোমাদের সাঙ্গলীলায় শকুনের লালা ব্যতীত একমুঠো মাটিও জুটবেনা।