আমি এক নিম্নশ্রেণির অফিস কর্মচারী
রোজ খুব ভোরে অফিস গাড়ি ধরতে
কখনো কখনো সকালের জলখাবারটাও জলাঞ্জলি দিতে হয়;
কেননা যদি গাড়ি মিস হয়,
মাসের খরচ বাড়বে, সাথে জুটবে বড়কর্তার তেতোবাণী ।
মাঝে মাঝে গাড়ির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা
যৌতুকে পাওয়া হাতঘড়িটায় মিনিটের কাঁটা ষাটটি ঘর অতিক্রম করে
তবুও গাড়ির দেখা মেলে না,
অন্যদিকে পায়ের শিরা-উপশিরা কঁকিয়ে বলে, ধুর ছাই এ কোন অধমকে সঙ্গ দিচ্ছি!

বলতে পারেন এ যুগে এসেও গাড়ির নেভিগেশন না দেখে বাহির হওয়া, এ কি বোকামি নয়!
তা ঠিক!
কিন্তু আমার যে স্মার্টফোন নেই,
যা একবার খরচ বাঁচিয়ে নিয়েছিলাম, চোরবাবু তার দুরন্ত কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে
আমার অজস্র ঘাম ঝরানো, অনেক চাওয়াকে উপেক্ষা করা অর্জনকে সস্তায় চোরবাজারে বেচে দিলেন।
অন্যদিকে অবস্থানের জিজ্ঞাসায় ড্রাইবারকে কল দিলে
উল্টো মোটা ও উঁচু স্বরে ধমকে বলেন, “আপনি কই আছেন?”
এ বিড়ম্বনায় কল না দিয়ে,
শিরা-উপশিরার তীব্র প্রতিবাদ উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকি গাড়ির আগমনের, এ যেন শত-সহস্র অপেক্ষা;
কেননা আমি নিম্নশ্রেণির কর্মচারী হতে পারি
কিন্তু আমার পুরো শরীর ভিতর-বাহির আত্মসম্মানের চাদরে মোড়ানো।

আর হ্যাঁ, হাতঘড়িটা বিয়ের সময় জানতাম শ্বশুরজি তার জামাতাকে ভালবেসে উপহার দিয়েছেন
কিন্তু গিন্নি বললেন, “সমাজে একটা অলিখিত বিধি আছে
অফিসের বড় কর্তা জামাতা হিসেবে কিছু পেলে হয় উপহার
আর নিম্নশ্রেণির কর্মচারী জামাতা হিসেবে কিছু পেলে হয়ে যৌতুক।”
আমার অবশ্য এ নিয়ে কোনো বিকার নেই
কেননা একেতো আমি নির্ভেজাল মানুষ
উপরন্তু বদনখানায় অফিসিয়ালি-আনঅফিসিয়ালি অসহায়ের যে ছাপ লেগেছে
উকিলবাবু আমার বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা নিবেন, তা মনে হয় না।

যাকগে সেসব কথা, এত ভেবে কাজ নেই
আমি যে এক নিম্নশ্রেণির অফিস কর্মচারী।

অফিসে ছোট-বড় যেকোনো কর্ম আয়োজনে
সম্মানিত লেখক ইব্রাহিম খাঁর ভাঙ্গাকুলার মতো ডাক পড়ে
আমিও সুবোধ বালকের মতো চিত্ত হৃদয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি
তবুও কি আটকপালে আমার!
ভোগের আয়োজনে আমি নেই।
বরং কোনো বিচ্যুতি ঘটলে,
একগাদা কটুবাক্য যন্ত্রমন্ত্রের ন্যায় নাজিল হয় বদনখানায়।
বলা হয়, কাজের সময় চোখ-কান-নাক
শরীরে যত ধরনের গোপন-বাহির দরজা আছে
সব যেন উদার হয়ে থাকে।
অথচ বড় কর্তার হেঁয়ালিপনা আর লীলানৃত্যে
সকল দরজা অষ্টধাতু দিয়ে সিলগালা করতে হবে।
আমি ভাই নিম্নশ্রেণির কর্মচারী, সকল দরজায় বন্ধ রাখি
তবুও মাঝে মাঝে দু-কপোলে এক-দুফোটা ঘনীভূত বাষ্প উবে উঠে;
আজকাল অবশ্য ঢাকঢোল পিটিয়ে হারানো বিজ্ঞপ্তি দিয়েও, তা খুঁজে পাওয়া বড়ই দুষ্কর।

বলতে পারেন, এতই যেহেতু অভিযোগ, তাহলে যোগ্যতা থাকলে বড় কর্তা হতে!
যথার্থ!
সকল অনুকূল-প্রতিকূল সাধ্য-অসাধ্য বাঁধা পেরিয়ে
বড় কর্তার সমান পড়াশুনা করেছি
কেউ কেউ বলেন, “কেন যে তাড়াহুড়োয় চাকরিটা নিয়েছিলে!
উচ্চশিক্ষা শেষে কিছুদিন ধৈর্যসমেত সাধন করলে
বড়কর্তার আসন তুমিই পেতে।”
তখন আমার ভেতর সকল সেতু্‌-উপসেতু দুর্ধর্ষ এক টর্নেডোর আঘাতে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।
নিজেকে এক নিরীহ অপরাধী মনে হয়।
অথচ কালের ভয়াল থাবায় কত আপন আমার নাই হয়ে গেছে, পড়ে আছে শুধু দীর্ঘশ্বাস।
বলা বাহুল্য, এতসব ভিতরের কার্যক্রম অবশ্য আমার বাহ্যিক বদনে দৃশ্যমান হয় না
কেননা আমি যে পুরোদস্তুর আত্মাদর নিম্নশ্রেণির কর্মচারী।

বলতে পারেন, কত নিম্নশ্রেণির কর্মচারীকে দেখেছি আকাশ ছুঁতে!
সত্য!
আমি পারিনি, এতকালের সাক্ষী হয়েছি, সময় না চাইতে ঝাপসা দেখছি
মনে হয় না, আর পারবো।
কেননা আমার যে মুখগহ্বর ভর্তি তৈলের কারখানা নেই
জিবে লকলক করা লোভরস নেই
তথাকথিত স্মার্টনেস নেই
সাপের পা দেখার জো নেই
শুধুই আছে অখাদ্যের বদহজমের সিলমোহর।
মাঝে মাঝে বড়কর্তাকে বলতে ইচ্ছে করে,
শুধু তৈলযুক্ত খাবারে নয়, তৈলযুক্ত কথাতেও কোলেস্টেরল থাকে।
এতসব ভেবেও আমার খুব একটা কাজ নেই,
ভাবলে রাতে ঘুম হবে না,
ঘুম না হলে বদহজম হবে
ফলস্বরূপ সকালে হয় গাড়ি মিস হবে, না হয় অফিস
পরিণতি চাকরি কিংবা মাইনের ধমকি।

আমার অবশ্য এখন আর কোনো অভিযোগ নেই, নেই কোনো আপিল
কেনইবা থাকবে?
যেখানে শত-সহস্র খুনের অপরাধীকে বাঁচানোর হেতু
শহরের বড় বড় উকিলবাবুরা ভীড় জমান।
সেখানে আর যাইহোক বিচার চাওয়া দুঃস্বপ্নেরও দুঃস্বপ্ন।

তবে বিধির একটি বিধান সকলের জ্ঞাতার্থে
শেষ বিচারের দিন কমবে পুণ্য, ভর্ৎসনার পরিণামে।