জীবন জীবিকার প্রয়োজনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে বসতি গড়ে তোলা মানুষের চিরন্তন স্বভাব। সেই স্বভাবধর্মের সূত্র ধরেই বাঙালি আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে। আর বাঙালি যেখানেই গিয়েছে সেখানেই সঙ্গে করে নিয়েছে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। শুধু বাঙালিই নয়- চীনা, পাকিস্তানী ও আরবীয়রাও এদিক দিয়ে কোনো অংশে কম নয়। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচার-প্রসার ও পরবর্তি প্রজন্মদের এ বিষয়ে শিক্ষিত ও সচেতন করে তুলতে আমরা কতোটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছি?
বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া বাঙালিরা হয়তো নানা কর্মসূচী যেমনঃ বাংলা স্কুল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও উৎসবাদি আয়োজনের মাধ্যমে নিজেদের মনোরঞ্জনে যৎকিঞ্চিৎ তৃপ্তিলাভে সক্ষম হয়েছি। যদিও এ ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমরা সফল হয়েছি তবুও ব্যর্থতার পরিমাণই যে বেশী তা বোধ করি হলফ করেই বলা যায়।
এক সময় মা-বাবাদের মধ্যে ভীষণ প্রবণতা ছিলো যে, আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে অবশ্যই যে দেশে আছি সে দেশের ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আর সেজন্যে তাদেরকে কাঠ-খড় পোড়াতেও হয়েছে ঢের! তারা যতোটা মনোবল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন ততোটা সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই সে প্রবণতায় ভাটা পড়ছে। এখন অনেক বাবা-মায়ের মধ্যেই সেই মনোবল, প্রচেষ্টা কিংবা সদিচ্ছা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই আবার এর প্রয়োজনীতাকেও থুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন। বলছেন- তাদের সন্তান যে দেশে আছে সে দেশের ভাষা শিখবে, সে দেশে ভালো চাকরি করবে; এখানে বাংলার প্রয়োজনীয়তা কোথায়? আর ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা, কানাডা ইত্যাদি দেশে বসবাসকারীরা তো সন্তানদের ইংরেজী জ্ঞানলাভের কারণে এতটাই গর্বিত যে, অন্য কোনো কথার মোটেও তোয়াক্কা করেন না! অনেকের সন্তানই হয়তো যে দেশে আছে সে দেশের ভাষায় জ্ঞানার্জন করে কর্মক্ষেত্রে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে, তবুও আমরা কী হারাতে বসেছি, সে অংক ক’জনইবা কষছি?
ধরুন, আমরা যে দেশে বসবাস করছি সে দেশে আমাদের ছেলেমেয়েরা বেশ শক্ত অবস্থানেই আছে। কিন্তু আমরা কি নিশ্চিত করে বলতে পারবো, আমাদের সন্তানরা এমন আচরণ আত্মস্থ করতে পেরেছে যেখানে তারা সমাজের বা যৌথ পরিবারের ছোট-বড় সকল সদস্যদের সাথে শালীনতা ও সদ্ভাব বজায় রেখে আচরণ করতে কিংবা সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হতে পেরেছে? কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা সম্ভব হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নয়- সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
হ্যাঁ, যেহেতু আমাদের সন্তানরা ভিন্ন একটি পরিবেশে বেড়ে উঠছে কাজেই তাদেরকে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির জ্ঞানদান করা যে এতোটা সহজ নয়- তা জোড় দিয়েই বলা যায়। আর এর পেছনে যে একাধিক প্রতিবন্ধকতা নেই, তাও বলছি না। আমার ঘরে আমিই যখন আসামী তখন অন্যের কথা কীইবা আর বলবো! কিন্তু এর ফলে আমরা যা হারিয়েছি বা হারাচ্ছি তা কিন্তু নগণ্য নয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ সন্তানদের মানসিক বৃদ্ধি, আত্মবিশ্বাস ও আত্মপরিচয়, নিজ দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা, শোভন আচরণ ও পিতামাতাসহ যৌথ পরিবারের অগ্রজ সদস্যদের সঙ্গে মানসিক ঘনিষ্টতা।
অগ্রজদের সঙ্গে আত্মিক ও মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার ফলে যৌথ পরিবারের ধারণা, বিশ্বাস ও কার্যকারিতা বিনষ্ট হচ্ছে; মানুষ ঝুঁকে যাচ্ছে আজকাল একক পরিবারের দিকে। যৌথ পরিবারে ছোট-খাট ভুলত্রুটি মেনে নেয়া, পারষ্পারিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতা, ছোটদের প্রতি বড়দের স্নেহ-মমতা, বড়দের প্রতি ছোটদের অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস- এসব হারিয়ে যাচ্ছে আজ অজানার অন্ধকারে; ফলে দেখা দিচ্ছে পারিবারিক নানা দ্বন্ধ-কলহ ও ভাঙ্গন। বৃহৎ পরিসরে সন্তান যে মন-মানসিকতা ও মনোবল নিয়ে বেড়ে উঠে তা দিয়ে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহসী ও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়; সেটিও আজ তলিয়ে যাচ্ছে যুগ-ধর্মের গড্ডালিকা প্রবাহে।
এমনভাবে চলতে থাকলে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন একদিন কোথায় যেয়ে ঠেকবে, তা কেবল মহান আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। তবে আমরা যে, দায়মুক্তি পাবো কোনো উৎকুচের বিনিময়ে- তা মনে হয় কিছুতেই সম্ভব হবে না। তবুও আশা রাখি- আমাদের বোধ জাগ্রত হোক, আমরা সন্তানাদিকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলি, তাদের সাথে আমাদের আত্মার আত্মীয়তা গড়ে উঠুক, তারা মানুষ হয়ে তাদের পরহিতকর কর্মের মাধ্যমে চিরদিন বেঁচে থাকুক সমাজবাসী প্রতিটি মানুষের মনে!
লেখকঃ অধ্যাপক, কবি ও অনুবাদক।