আমি যখন প্রথম হাত উঁচিয়ে মিছিল দিই
জয় বাংলা, জয় বাংলা!
তখন বয়স আমার কতইবা হবে- পাঁচ কি ছয়
একাত্তরের সেইসব উত্থাল দিন
আকাশে জঙ্গী বিমানের আনাগোনা
ভয়ার্ত হৃদয়ে মানুষের তখন প্রহর-গোনা।
আমার সম্পর্কে ভগ্নীপতি এক- ভীষণ ভীতু
ঢাকায় ফেলে সরকারী চাকরি
আশ্রয় নিলেন আমাদের গ্রামের বাড়ি।
আমার তর্জনী চেপে ধরে হাত নামিয়ে বললেন,
‘‘হাত দেখলে বিমান থেকে গুলি ছুঁড়বে,
আমাদের মেরে ফেলবে!’’
আচ্ছা! মেরে ফেলা কী?
আমি কি সেদিন তা জানতাম?
মনে হয় না!
এরপর প্ররোচিত করলেন বলতে
পাকিস্তান-জিন্দাবাদ
অথচ, কচিমন আমার সায় দেয়নি মোটেও
কলাকৌশল করলেন তিনি অনেক যদিও।
তাকে ক্ষ্যাপাতে গিয়ে
এবারে খেলার সাথীদের দল নিয়ে
আমি আবারো ধরলাম-
জয় বাংলা, জয় বাংলা!

মুক্তিযুদ্ধে যা যা হয়েছে তা শুনেছি বটে
কিন্তু এর একটিও দেখিনি আমি
তবে ‘পাঞ্জাবী আইছে, পাঞ্জাবী আইছে.....’
শোরগোলে তটস্থ হতে দেখেছি জনতা
হাট ভেঙ্গে জনশূন্য হয়েছে বাজার
কেরোসিন লুকিয়ে রাখতে হয়েছে
পাকসেনারা আগুন লাগিয়ে দেবে বলে
পাতার বিড়ি রাখতে হয়েছে মাটি পুঁতে
গুলি করে মেরে ফেলবে বলে।

একদা বিকালে যাচ্ছি মাযার জিয়ারতে
আমার একমাত্র দুলাভাইয়ের সাথে
মুচি বেটা এক দৌড়ে এসে
জিজ্ঞাসিলো ব্যাকুল আশে,
"সা..ব!  সগ্রাব (সংগ্রাম) কমবো নি?
প্রবল আত্মবিশ্বাসে দুলাভাই শুধালেন,
“কমবো না-নি, কমবো!”
অতপর সংগ্রাম ঠিকই একদিন কমলো
মানুষের জানও যেনো ফিরে এলো!
অথচ ফিরে এলো না মায়ের কোলে
বাংলার অসংখ্য দামাল ছেলে!

একাত্তরের প্রায় প্রতিরাতে
বড়ভাইয়ের নেতৃত্বে বাড়িতে
মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন বৈঠক দেখে দেখে
মেজুভাইয়ের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায়
পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারের
লোমহর্ষক বর্ণনা শুনে শুনে
আমি কি সেদিন-
শিশু মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠেছিলাম?
ঠিক জানি না!  
তবে এটুকু জানি-
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কেমন যেন একটা  
অনুভূতি জন্মেছিল আমার
যাঁরা প্রাণ দিয়ে স্বাধীনতা আনলো-
তাঁদের জন্যে প্রাণ আমার কেমন জানি করতো!
মনে হতো, মুক্তিযোদ্ধার শোণিত-ধারা বুঝি
বহমান আমার রক্ত-বানে;
মুক্তিযোদ্ধার মিছিল তাই
হাতছানিতে আমায় টানে।
আর সেই থেকে আমি
কেবলই মুক্তিযোদ্ধার মিছিলে যাই।
মুক্তিযোদ্ধার মিছিলে যাই।