রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যে কয়টি সমালোচনা শুনা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রথমত তিনি ছিলেন বাংলার অখন্ডতায় বিশ্বাসী ,ব্রিটিশদের প্রতি উদার এবং মোসলমান তথা মোসলিম ধর্মবিশ্বাসের প্রতি বিদ্বেষ পরায়ন।
অনেকে আবার ভারতের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দির সুপারিশকারী রবীন্দ্রনাথ, এর দায় রবীন্দ্র সমালোচনায় মুখর।
রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হলে আমাদের রবীন্দ্র সময়কাল কে বিচার করতে হবে। একটি পরাধীন দেশ যেখানে অশিক্ষা ,দারিদ্রতা ,বর্ণ বৈষম্য এবং জাতিভেদ প্রথা সমাজ ও রাষ্ট্র কে খন্ডিত ও বিখন্ডিত করে রেখেছে সেখানে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে রাষ্ট্রীয় অখন্ডতার পক্ষে অবস্থান কতটুকু দুষনীয় তা অবশ্যই বিচার্য।
এটি সত্য যে বাংলার পুর্বাংশীয়রা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়ার প্রেক্ষিতে বঙ্গভঙ্গের পক্ষপাতি ছিলেন। অবহেলিত ও দলিত শ্রেনীর অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিল তাদের কাম্য।
১৭৫৭ সালের পলাশীর বিয়োগান্তক ঘটনা বাঙালী জনজীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। পলাশী পূর্ব বাঙালী ছিল অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল, সামাজিক ভাবে একতাবদ্ধ তবে রাজনৈতিক দিক দিয়ে একেবারে অসচেতন। পলাশী পরবর্তী বাঙালী জনসমাজের অর্থনীতির ভীত দুর্বল এমনকি বুনিয়াদী সামাজিক দৃঢ়তা না থাকলেও বাঙালীর মনন ও চিন্তায় আসে স্বকীয়তা , আধুনিক ও যুগোপযুগী শিক্ষা নিয়ে কতিপয় শ্রেণীর মধ্যে নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করার আকাঙ্খা তীব্রতর হয়।
আধুনিক শিক্ষিত এই এলিট শ্রেণী সরকারী চাকুরী অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কর্ম ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়। অপরদিকে পলাশী পূর্বকালীন সুবিধাভুগী শ্রেণী অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। কতিপয় মানুষ রাজনৈতিক সচেতন হয়ে উঠে অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে হয়ে উঠে ক্ষুব্ধ। বিনষ্ট হয় হাজার বছরের সহবস্থানের সুসম্পর্ক।
বিভাজন কর আর শাসন কর এই নীতিকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ বেনিয়ারা আমাদের মাথার উপর জগদ্দল পাথরের মতো বসে থাকে। মুক্ত চিন্তক ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকারীরাও এর শিকার হন ,রবীন্দ্রনাথও তাঁর থেকে ব্যতিক্রম নন।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম নিয়ে এ যাবৎ যত বাক বিতন্ডা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ কে ঘিরে। রবীন্দ্র কর্মের চেয়ে রবীন্দ্র চরিত্র হয়েছে সমালোচনার শিকার।
রবীন্দ্র সময়কাল ও তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই তিনটি দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন আক্রমনের শিকার।
তুলনামূলকভাবে কম রক্ষণশীল চিন্তা ও চেতনায় আধুনিক রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম আক্রমনের শিকার হন তৎকালীন হিন্দু ধর্মান্ধ শ্ৰেণী দ্বারা।
রবীন্দ্রনাথ জাতপাত ,আচার আচরন ভেদের অমানবিকতাকে সামাজিক পাপ হিসাবে চিহ্নিত করেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে এগুলো বর্জনের উপদেশ দেন। বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেন।
ঠাকুর পরিবারের খ্যাতি ও আধুনিকতা ,প্ৰচলিত সমাজ ও সংস্কৃতিকে অস্বীকার এক তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে হিন্দু সমাজে।
রবীন্দ্রনাথের ধর্ম চিন্তা ও দর্শন ভাবনা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ঐতিহ্যবাহী ও অভিজাত হিন্দু কোলে তাঁর জন্ম। হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্যেই তিনি বড় হয়ে উঠেন। হিন্দু গর্ববোধ তাঁর মধ্যে সতেজ ছিল। আর্য রক্তধারার বিশুদ্ধতা রক্ষায় তৎপর এই ব্যক্তিটি একসময় রাজা রাম মোহন রায় ও পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথের প্রভাবে ব্রহ্ম ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।
ভাববাদী রবীন্দ্রনাথের বাস্তববাদে এই উত্তরণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। নাট্যকার ডি এল রায় সহ অনেকেই রবীন্দ্রনাথের এই চিন্তা জগতের সমালোচক হয়ে উঠেন। যদিও রবীন্দ্রনাথ ভাববাদকে পুরোপুরি বিসর্জন দেননি। ভাব ও ভক্তিবাদের সাথে বস্তবাদের সমন্বয় ঘটিয়েছেন মাত্র। ঈশ্বর ও পরমাত্মার সন্ধান মানুষের মধ্যে করেছেন রবীন্দ্রনাথ,ঈশ্বর অস্বীকারকারী হয়ে উঠেননি তিনি।
একজন সমাজ সচেতন ও চিন্তক হিসাবে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি রাজনীতি সম্পৃক্ত না হলেও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ও চেতনা মানুষকে প্রভাবিত করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি তাঁর দুর্বলতা ,স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি সমর্থনদান ও বঙ্গবঙ্গের তীব্র বিরোধিতার কারনে কবি আরও একটি শক্তি দ্বারা সমালোচিত এমনকি তাঁদের নিকট অগ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেন।
সময়ের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল ও অর্থনৈতিক ভাবে অসচ্ছল এই শ্রেণীটি ছিল পূর্ববঙ্গীয় মোসলমান ।
মোগল আমলে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রিক শাসন ও পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনকালে কলকাতা পূর্ব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী হওয়ায় বাংলার উন্নয়ন মূলত পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
ইংরেজদের সূর্যাস্ত আইনের প্রেক্ষিতে অনেক মুসলিম জমিদার রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে যায় । ১৯০৫সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বাংলা ও আসাম স্বতন্ত্র ভাবে পরিচালিত হওয়ায় এতদঅঞ্চলের মানুষের মধ্যে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার এক নতুন সম্ভাবনা তৈরী হয়।
ঠিক এই সময়ে ভারতীয়দের মধ্যে খিলাফত আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলন যুগপৎ ভাবে চলছে । অনেকের মতো রবীন্দ্রনাথের মনেও দাগ কাঠে যে,বঙ্গভঙ্গ হচ্ছে বাঙালীদের দমিয়ে রাখার জন্য ইংরেজদের কূটকৌশল।
রবীন্দ্রনাথ অভিজাত বংশীয় ও জমিদার। কৌলিন্য ও আভিজাত্যের অহমিকা যার চেহারায় তিনি'ত অবশ্যই প্রগতির অন্তরায় হবেন। রবীন্দ্রকালীন ও তাঁর পরবর্তী সময়েও অনেক বাম চিন্তকেরা এই ধারনা মনে পোষন করতেন। বামপন্থী লেখক ভবানী সেন সহ অনেকেই রবীন্দ্র বিরোধী ছিলেন। ষাট ও সত্তরের দশকে নক্সাল পন্থীরা এতো বেশী রবীন্দ্র বিরোধী ছিল যে রবীন্দ্র ভাস্কর্যও এরা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়।
ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ সমালোচিত হলেও রবিন্দ্র প্রতিভা বিশ্বমাত্রিক। চিত্রকলা সহ সাহিত্যের এমন কোন দিক নেই যা রবীন্দ্র স্পর্শে সঞ্জীবিত হয়নি। এই প্রতিভাকে তুলনা করা হয় সেক্সপীয়র,গ্যোটে বা টলস্টয়ের সাথে যদিও এদের কারো প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের মতো বহুমাত্রিক নয়।