১৮৫৭ সালের ব্যর্থ বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে আগ্রাসী ব্রিটিশ বেনিয়াদের কবলে যখন সারা দেশ ঠিক সেই সময়ে ১৮৬১ সালের ৭ ই মে, বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখ কলিকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্ম রবীন্দ্রনাথের । বলতে হয় এক আন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কে আলোকিত করতেই পরাধীন দেশে রবীন্দ্র আবির্ভাব ।
একাডেমীক পড়াশুনা স্কুল পর্যন্তই । জীবন, যুগ ,সময় থেকে অর্জিত জ্ঞান দিয়ে কবি দেখেন তাঁর সমাজ, সভ্যতা এবং দেশ । অনুভব করেন পরাধীনতার অনুভূতি । সন্ন্যাসী বেশে দার্শনিকতার চোখ দিয়ে অবলোকন করেন তাঁর সময়, সময়ের গভীরতা এবং যুগপরবর্তী প্রজন্ম কে ।
পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসাবে জীবনের প্রথমার্ধে ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা,ভালবাসা ও আকর্ষণ ছিল।এক বিশাল জমিদার পরিবারে যার জন্ম ,চারদিকে পাইক পেয়াদা আর বরকন্দাজ পরিবেষ্টিত সমাজে সাধারন থেকে বিচ্ছিন্ন রবীন্দ্রনাথের এই আকর্ষণটাই ছিল স্বাভাবিক ।
রবীন্দ্র প্রতিভা যখন সাধারনের স্পর্শে সঞ্জীবিত,আক্ষেপের সূর কবির কণ্ঠে , - ইংরেজদের একদা মানব হিতৈষী রূপে দেখেছি এবং কি বিশ্বাসের সঙ্গে ভক্তি করেছি ----।
কৈশোর কাল অতিক্রম করে যৌবনের প্রারম্ভে কবি লিখেন, - মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে । মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই ।
কবি বাঁচতে চান মানুষের মধ্যে । মানুষের জন্যই যার জীবন ও কর্ম । এই কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকার চেষ্টা । মানুষ ও মানবতার মধ্যে বেঁচে থাকার কি আকুতি ।
কবি তাঁর ব্যক্তি ধারাকে বিশ্ব প্রবাহের অখণ্ড ধারায় মিলানোর আকুল আগ্রহ নিয়ে লিখেন , -
শতেক কুটি গ্রহ তারা যে স্রোতে তৃণ প্রায় ,
সে স্রোত মাঝে অবহেলে চলিয়া দেব কায় ,
অসীম কাল ভেসে যাব অসীম আকাশেতে ,
জগতকাল কলরব শুনিব কান পেতে ।
পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল অপরিহার্য । এই অপরিহার্যতা সত্বেও কবি ছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদের তীব্র বিরোধী । ১৯২৫ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে কবি স্বদেশী আন্দোলন কে বিদ্রূপ করে লিখেন, - এটি হচ্ছে চরকা সংস্কৃতি ।
১৯১৩ সালে নোবেল পুরুস্কার লাভের পর ১৯১৫ তে ব্রিটিশ সরকার কবিকে ইংল্যান্ডের সব চেয়ে সম্মান জনক বেসামরিক খেতাব নাইটহুড প্রদান করে । ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মানবতাবাদী কবি অনেক ভারতীয়দের নিকট আরাধ্য এই খেতাব ঘৃণা ভরে ত্যাগ করেন । মানব ইতিহাসে ইতিপূর্বে বা পরবর্তী সময়ে মানুষ ও মানবতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে এই ধরনের যুগান্তকারী ঘটনা খুব কমই দেখা যায় ।
১৯১৩ সালে প্রাপ্তির মাধ্যমে তিনি আমাদের সম্মানিত করেন । বলতে হয় ১৯১৯ সালে তাঁর পূর্ণতা লাভ ত্যাগের মাধ্যমে । এই প্রাপ্তি ও ত্যাগের মাধ্যমে স্বদেশ ও স্বজাতিকে সম্মানিত করা একমাত্র রবীন্দ্রনাথের দ্বারাই সম্ভব ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালীন সময় ও তার পরবর্তীতে কবি দেশে দেশে ঘুরে বেরিয়েছেন । সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদের দাম্ভিকতা দেখে কবি লিখেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় আত্মোপলব্ধির দলিল – সভ্যতার সংকট ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী চেহারা দেখে বিচলিত কবির ভাষায়, - ইউরোপের দম্ভ ও লোভ যে সর্বজাতির কল্যাণ যাত্রার পথকে রুদ্ধ করে জগদ্দল পাথরের মতো সবার বুকে চেপে বসে থাকবে তা কখনও বিধাতার অভিপ্রায় হতে পারে না ।
কালান্তর গ্রন্থে এশিয়া ও আফ্রিকার নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কবির সুদৃঢ় অবস্থান প্রকাশ পায় ।
ভাববাদ , ভক্তিবাদ এমনকি জাতীয়তাবাদ যার প্রারম্ভিক জীবনের বৈশিষ্ট, সময়ের প্রেক্ষাপটে তিনি হয়ে উঠেন আগ্রাসন বিরোধী বিশ্বমানবতাবাদীদের আদর্শ । সাম্রাজ্যবাদ ও কট্টর জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করে উপেক্ষিত হন ইউরোপ,আমেরিকা,জাপান এমনকি মুসলিনির ইটালিতে ।অকুতোভয় কবি লিখেন, - চিত্ত যেথা ভয় শূন্য । অথবা –একলা চলোরে ...।
১৯৩৩ সালে পার্শী যুব সমিতি আয়োজিত এক সভায় ইউরোপের আগ্রাসী আচরণ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত এক আলোচনায় কবির বক্তব্য – বেয়নেটের মুখে আমাদিগকে তাহারা বিশ্বাস করাইয়াছে যে তাহারাই ভগমানের একমাত্র নির্বাচিত শ্রেষ্ট জাতি । ..... আমার মনে হয় সবচেয়ে সর্বনাশের মুল হইতেছে উৎকোচ দ্বারা প্রাচ্যের সকল জাতিকে তাহাদের ভবিষ্যৎ বিকাইয়া দিতে বাধ্য করা । ( সাপ্তাহিক দেশ ২ রা ডিসেম্বর ১৯৩৩ )
অসলোতে নোবেল বক্তৃতায় কবি – এক জাতির সাথে অন্য জাতির, এক ব্যক্তির সঙ্গে অন্য ব্যক্তির সংঘাত হওয়ার মধ্যে নয় , মানুষের কর্তব্য হচ্ছে একের সঙ্গে অন্যের ভাতৃত্ব আর শান্তির সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাওয়া ।
জাপানি এক কবি ইয়নে নগুচির পত্রের উত্তরে ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য – জাতীয়তার চেয়ে অনেক বড় হচ্ছে মানবতা ।
বিশ্বমানবতা ও শান্তির প্রতি রবীন্দ্রনাথের অমিত ইচ্ছা সাধনার ফসল তাঁর নিজ হাতে গড়া বিশ্ব বিদ্যাপীঠ- শান্তি নিকেতন ।
জমিদার বলতে যে যুগে অত্যাচারিএবং প্রজা শোষক বলে মানুষ জানত সেই যুগে তিনি প্রজা পীড়কত হননি বরং প্রজাদের খাজনা মওকুফ করে দেন। মহাজন ও সুদখোরদের হাত থেকে প্রজা রক্ষায় নোবেল পুরুস্কারের সমুদয় অর্থ ব্যায়ে তাঁর জমিদারী এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন কৃষি ব্যাংক ।উত্তরবঙ্গের পতিসরে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক আজও তার সাক্ষী বহন করছে ।
মানুষ ও মানবতা বোধের যে সত্যতা কবি উপলব্ধি করেন তা ফুটে উঠে তাঁর বিশ্ব নৃত্য কবিতায় –হৃদয় আমার ক্রন্দন করে মানব হৃদয়ে মিশিতে / নিখিলের সাথে মহারাজ পথে চলিতে দিবস নিশীতে ।
কবি মনে করেন মানুষের সাথে মানুষের হৃদয়ের যে সম্পর্ক সেটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ সম্পদ । কবির কণ্ঠে – দূরকে করিলে নিকট বন্ধু , পরকে করিলে ভাই ।
১৫ই জানুয়ারী ১৯৩৪ বিহারে ভূমিকম্পে প্রচুর মানুষ হতাহত হয় । গান্ধীজী একে দলিতদের বশীভূত করতে ঈশ্বরের প্রতিশোধ বলে আখ্যায়িত করেন । রবীন্দ্রনাথ তীব্র ভাষায় এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে গান্ধীজী কে তিরস্কার করতেও দ্বিধাবোধ করেননি ।
আসামের শিলং যাত্রা পথে ১৯২৬ সালে কবি সিলেট আসেন। শেখঘাটে যখন কবির জলযান ভিড়ল আসামের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া সহ বিশিষ্টজনেরা কবিকে নিয়ে আসতে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মনুষ্য যান পালকি নিয়ে হাজির হন । মানুষ ও মানবতার কবি অতি বিনয়ের সাথে মনুষ্যযানে অরোহন করতে অপারগতা প্রকাশ করেন ।
১৯৩০ সালে ইংল্যান্ড সফর কালীন সময় বার্মিংহামের ধর্মীয় ভ্রাতৃ সংঘে অবস্থান কালে কবি লিখেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তাঁর বিখ্যাত হিবার্ট ভাষণ । যার বিষয়বস্তু ছিল– আমাদের ঈশ্বরের মানবতাবোধ এবং মানুষ ও পরমআত্মার স্বর্গীয় রূপ ।
কষ্ট, দুঃখ, সামাজিক বৈষম্য,ধর্মীয় গোঁড়ামি,জাত ও পাতের ভেদাভেদ , পণ প্রথা , নারীর প্রতি অবিচার ও অবহেলা অর্থাৎ সমাজের রন্ধে রন্ধে ঘাপটি মেরে বসে থাকা আগ্রাসী এই সব মানবতা বিরোধী অপরাধ কে অত্যন্ত সুনিপুন ভাষায় কবি ফুটিয়ে তুলেন তাঁর গল্পে উপন্যাসে ও কবিতায় । এমনকি তাঁর চিত্র কর্মেও এর ছাপ দেখতে পাওয়া যায় ।
দুই বিঘা কবিতায় সবলের প্রতি দুর্বলের অত্যাচার উঠে আসে এই ভাবে – শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবি গেছে ঋনে / বাবু কহিলেন – বুঝেছ উপেন এই জমি লইব কিনে ।
প্রশ্ন কবিতায় কবি – আমি যে দেখেছি প্রতিকার হীন শক্তির অপরাধে / বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে । / আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উম্মাদ হয়ে ছুটে / কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে ।
এক জন ব্রাহ্মণ , উঁচু জাত বলে সমাজে যার অবস্থান । নিম্ন বর্ণ কিংবা যবন স্পর্শ যার জন্য গুরুতর অপরাধ , এ কেমন বিদ্রোহ যখন তাঁর কণ্ঠে – এসো হে আর্য , এসো অনার্য , হিন্দু মুসলমান / এসো এসো আজ তুমি ইংরেজ , এসো এসো খ্রিষ্টান । / এসো ব্রাহ্মণ , সূচি করি মন ধরো হাত সবাকার / এসো হে পতিত , হোক অপনীত সব অপমান ভার । / মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা , মঙ্গল ঘট হয়নি যে ভরা / সবার পরশে পবিত্র করো তীর্থ নীরে / আজি ভারতের মহামানবের সাগর তীরে ।
আমরা রবীন্দ্রনাথকে কবি , সাহিত্যিক ,গীতিকার , নাট্যকার , ছোট গল্পের জনক এমনকি চিত্র কর হিসাবে জানি কিন্তু এর বাইরেও রবীন্দ্রনাথের আরেকটি পরিচয় আছে । তিনি একজন মানুষ দরদী মানুষ, একজন প্রকৃত মানুষ ।
রবীন্দ্র পরবর্তী প্রজন্ম হিসাবে আমাদের দুঃখবোধ আছে আমরা রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি । ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের স্পর্শে সঞ্জীবিত হতে পারিনি, তবে রবীন্দ্রপূর্বদের চেয়ে আমরা এদিক দিয়ে সৌভাগ্যবান যে আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকে শিখছি । রবীন্দ্র আলোতে আমাদের চিন্তা ও চেতনা কে করছি উদ্ভাসিত ।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন,ভাষা আন্দোলন,স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা এমনকি আমাদের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যখন আগ্রাসী শক্তির খড়গহস্থ আমাদের উপর,আমরা শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করছি রবীন্দ্রনাথ থেকে । বাংলা ও বাংলা সাহিত্যের সর্বযুগ জয়ী এই প্রতিভার উদ্দেশ্যে বলতে হয় -
রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই আমরা
আমাদের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ,
এই হোক পরিচয় আমাদের
আমরা রবীন্দ্রনাথের লোক ।