বাংলা কবিতার ইতিহাস মূলতঃ তার ভাষা ও আঙ্গিকের ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাস।ঢেউয়ের মত নানা ওঠা নামায় উদ্বেল হয়েছে সে ইতিবৃত্ত।
আমাদের প্রথম কবিতা ধরা হয়ে থাকে চর্যাপদ :
কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চি এ পইঠো কাল।।
চর্যাপদের এ ভাষা সান্ধ্যভাষা ।একে অতিক্রম করে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন,বৈষ্ণব পদাবলী,রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদ,মঙ্গলকাব্য পর্যন্ত মোটামুটি এক সহজ,স্বচ্ছন্দ ভাষার প্রচলন হল।
যেমন,বৈষ্ণব পদাবলীকার জ্ঞানদাসের একটি পদ:
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুনে মন ভোর
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দি প্রতি অঙ্গ মোর।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দি,
পরান পরিচিতি মোর থির নাহি বান্ধে।
এরপর মাইকেল মধুসূদন দত্ত ঝড়ের মতন এসে বাংলা কবিতায় এক বিপুল পরিবর্তন ঘটালেন।যে মানুষটি প্রথম জীবনে ভালো করে বাংলা জানতেন না,পৃথিবী শব্দের বানান লিখতে যার অসুবিধা হত বলে শোনা যায়,সেই তিনি সংস্কৃত,আভিধানিক,
অপ্রচলিত শব্দ ঝঙ্কারে বাংলা কবিতাকে এক অভিজাত পর্যায়ে উন্নীত করলেন।অন্ত্যমিল বর্জন করে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করে সকলকে চমকে দিলেন।পরবর্তী কয়েক দশক অনেক কবিরাই অনুসরণ করলেন এই ধারা।যেমন,নবীন চন্দ্র সেন কিংবা হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
মাইকেলের লেখার উদাহরণ:
হে বঙ্গ,ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন ;
তা সবে,( অবোধ আমি !) অবহেলা করি,
পর- ধন- লোভে মত্ত,করানো ভ্রমে
প্রদেশে,ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
রবীন্দ্রনাথ এই মাইকেল ধারা ভাঙলেন।অবশ্য এর আগে যুগ সন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং ইয়োরোপীয় ভাবধারার ভোরের পাখি বিহারীলাল চক্রবর্তী এসে গেছেন। কৃত্রিম ভাষা পরিহার করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব কাব্যভাষা নিয়ে আপামর বাঙালীর হৃদয়ে পৌঁছলেন।যদিও সহজে বা একদিনে রবীন্দ্রনাথকে মেনে নেননি মোহিতলাল রায়,ডি এল রায় বা কাজী নজরুল ইসলামও।এরপর আধখানা শতাব্দী জুড়ে রবীন্দ্র অনুসারী বহু কবি বাংলা সাহিত্যে বিরাজ করেছেন।
রবীন্দ্র কবিতার কয়েক লাইন:
নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে,নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানাতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।
তিরিশের দশকে আবার একদল কবি প্রকাশ্যেই রবীন্দ্র বিরোধিতা করে অন্য ধারায় লিখতে শুরু করলেন।তাদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,জীবনানন্দ দাশ,বুদ্ধদেব বসু,অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে অন্যতম।
এই পঞ্চকবিদের কপালে জুটেছিল নিন্দা উপহাস এবং আধুনিক কবি নামের আড়ালে দুর্বোধ্য কবির তকমা।
এই আধুনিক কবিদের মনে হয়েছিল, মহাযুদ্ধ,শিল্প বিপ্লবের ফলে সারা পৃথিবীব্যাপী কবিতা,সাহিত্যে যে পরিবর্তন ঘটছিল বাংলা সাহিত্য তার ব্যতিক্রম হতে পারে না।এরা সকলেই ছিলেন ইংরেজী ভাষায় সুপন্ডিত ও ইংরেজী কবিতার অনুরাগী। এরা গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন কিটস,এলিয়ট,বোদলেয়র এবং তাদের কবিতায় এদের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট।
যেমন,কিটস লিখেছেন:
Much have I travelled
জীবনানন্দ সেখানে লেখেন,
অনেক ঘুরেছি আমি।এবং
Then feel I like some watcher of the skies
When a new planet swims into his ken
Or like start Cortez when with eagle eyes
He stare'd at the Pacific
জীবনানন্দর কাছে হয়ে যায়:
.....অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারিয়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশে যখন সে চোখে দেখে
দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,
তেমনই দেখেছি তারে অন্ধকারে ...
কিন্তু সাধারণ পাঠক ইংরেজী কবিতার সাথে সেভাবে সম্পৃক্ত না থাকায় দিকপাল কবিদের কবিতাগুলি অনুসরণ করতে ব্যর্থ হলেন।অথবা বলা যায় যে,তাঁদের কবিতার ভাবের ও ভাষার জটিলতা ও দুর্বোধ্যতা সাধারন পাঠককে বাংলা কবিতা থেকে দূরে সরিয়ে নিল।
আবার সময় বদলাল। শক্তির পরে সুনীল অথবা সুভাষ- নীরেন্দ্রনাথ প্রমুখ সহজ ভাষা ফিরিয়ে এনে পাঠকদের আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেন।
সুনীল লিখলেন:
শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম,
শুধু কবিতার জন্য কিছু খেলা,
শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধ্যেবেলা
ভুবন পেরিয়ে আসা,শুধু কবিতার জন্য
....... .........
মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা,শুধু
কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।
পরবর্তী সময়ে শঙ্খ ঘোষ বা জয় গোস্বামীর যে কবিতাগুলি জনপ্রিয় ও কালজয়ী বলে চিহ্নিত হল সেগুলি অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষার নির্মান নিঃসন্দেহে।সহজ শব্দটি বললাম বটে,তবে ভুললে চলবে না রবি ঠাকুরের সেই কথাটি : সহজ কথা যায় না বলা সহজে।
জয় গোস্বামীর একটি ছোট্ট কবিতা ' অপেক্ষা':
যতবার বেল বাজে
ভাবি তুমি এলে
দরজা খুলে দেখি,অন্য কেউ
মনে ঢেউ ওঠে,মনে
মরে যায় ঢেউ ।
পরিশেষে,বাংলা কবিতার কথা বললে ওপার বাংলার কবিতার কথা তো বলতেই হবে।ওপার বাংলার স্বনামধন্য কবিদের মধ্যে শামসুর রহমান,মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান,রফিক আজাদ,হেলাল হাফিজ,নির্মলেন্দু গুন,রুদ্র মহম্মদ উল্খেযোগ্য।
উদাহরণ হিসেবে নিই হেলাল হাফিজের একটি ছোট কবিতা ' অনির্নীত':
নারী কি নদীর মতো
নারী কি পুতুল,
নারী কি নীড়ের নাম
টবে ভুল ফুল
নারী কি বৃক্ষ কোনো
না কোমল শিলা,
নারী কী চৈত্রের চিতা
নিমীলিত নীলা !