কবি জয়শ্রী কর বাংলা কবিতা ডট কমের আসরে এক পরিচিত নাম। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়া নিবাসী কবি অজিত করের সহধর্মিণী বিবিধ গুণের অধিকারী এই কবির তিনটি কাব্যগ্রন্থ 'নীল আকাশের কোলে','ভোরের পাখি' এবং 'মায়াডোর" ইতিমধ্যে প্রকাশিত। কবি ৩ বছর ৭ মাস আসরে আছেন।তার কবিতার সংখ্যা ৩২২।তার মধ্যে এখনও ২৬১ টি লিখেছেন 'পঞ্চকলি'।

'পঞ্চকলি' প্রতিটি পাঁচ লাইনের কবিতা।লিমেরিকের মত ককখখক ছন্দোমিলে লেখা। তবু এগুলিকে ঠিক লিমেরিক বলব না।কেননা,লিমেরিকের বক্তব্য সাধারনত: অর্থবোধক হয় না।কবি কোথাও তা দাবীও করেন নি। কবিতাগুলি অনেকটা ছড়ার ঢঙে এগিয়েছে।ছড়ার রস যেমন তীব্র ও গাঢ় হয় না,পঞ্চকলিগুলিও কবির সদা হাস্যমুখের মত স্নিগ্ধ ও সরল। বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে ছড়ায় তত্ত্ব ও উপদেশ থাকে না।এই কবিতাগুলিতেও যেখানেই উপদেশ দেবার চেষ্টা হয়েছে,কবিতাগুলি আর তত আকর্ষণীয় থাকে নি।কবির বেশিরভাগ কবিতায় ধরা আছে ছন্দের সাথে একটি আনন্দময় ছবি। কবি নিজেই বলেছেন:

ছোটো ছোটো কবিতা
দোলা দেবে সবই তা
আলোকিত
পুলকিত
হবে মন জানি তা।

নানান বিষয় নিয়ে কবির এই 'পঞ্চকলি'।
বাড়ির পাতাবাহার গাছটিকে নিয়ে যেমন লিখেছেন,পোষা বেড়ালকে নিয়ে সস্নেহে লিখেছেন,লাজে রাঙা ননদিনিকে নিয়ে তেমনি মজা করেছেন।পরিযায়ী ভুটিয়াদের নিয়ে যেমন লিখেছেন,হোলির দিনে কালো মেয়ের ইচ্ছে তার বিষয় হয়ে উঠেছে।ঝকঝকে আকাশের কথা,আবার বৃষ্টিদিনের কথা যেমন এসেছে,অসহায় ভিখারিনির কষ্ট তাকে নাড়া দিয়েছে,ঘরামির নিজের ঘরে চাল ফুটো,তাও তার চোখ এড়ায় নি।আবার প্রেমদিবসে প্রেমের মানুষের সাথে দিঘায় যেতেও তিনি ভোলেন নি।

আসুন,কয়েকটি ভাল লাগা পঞ্চকলি দেখে নেওয়া যাক:
এক।

ফ্রিজে কত সবজি কৌটাতে নেই নুন
তাই শুনে কর্তার মাথায় জ্বলে আগুন।
দ্রুত ছোটে দোকানে
নুন নেই সেখানে
খালি হাতে ফিরলেই নির্ঘাত হবে খুন।
                                    ( পঞ্চকলি ১)
দুই।

ও ননদি সাঁঝের বেলা রেখো না খোলা চুল
এসো না ভাই খোঁপা বেঁধে গুঁজি গোলাপ ফুল।
ঠাকুর জামাই আসবে রাতে
জল দিয়েছি গরম ভাতে
লাজে রাঙা লজ্জাবতীর গাল দুটি তুলতুল।
                                         (পঞ্চকলি ৭৫)
তিন।

ঢাকা থেকে আনল দাদা ঢাকাই শাড়ি
'দিঘা যাবো,ওটাই পরো তাড়াতাড়ি ।
আজ ভ্যালেন্টাইন
ভালোবাসার দিন
ওখান থেকে চন্দনেশ্বর,তারপর বাড়ি।
                                    ( পঞ্চকলি ১৭৫)
চার।

জাঁকিয়ে শীত পড়ল যেই, ভুটিয়াদের ভিড়
খুঁজে নেয় শহর- বুকে অস্থায়ী এক নীড়।
পরিযায়ী পক্ষী যেমন
ওরাও আসে শীতে তেমন
যাযাবর জীবন ওদের,নয় ওরা সুস্থির।
                                     ( পঞ্চকলি ১০৫)
পাঁচ।

কে পরাল অঙ্গে তোমার হলুদ বরণ শাড়ি
তোমার বিভায় উঠল রঙে আমার ছোট্ট বাড়ি।
তুমিই প্রিয় বন্ধু আমার
মনমোহিনী রূপের বাহার
ঊর্দ্ধপানে তাকিয়ে থাকো,চাও কি দিতে পাড়ি?
             ( রূপসী পাতাবাহার:পঞ্চকলি ২৬১ )
ছয়।

বৃষ্টি ঝরে অঝোর ধারায় নদীর বুকে বান
জলের ফোঁটা আওয়াজ তোলে ভেকের সে কি গান!
উঠোন প'রে জমা জলে
খুকুর তরী ভেসে চলে
চড়াই তিতির মহানন্দে নিচ্ছে সেরে চান
                                      ( পঞ্চকলি ৪)
সাত।

লাঠি হাতে বুড়ি হাঁটে কাঁধে নিয়ে ঝোলা
ভিক্ষেয় পেট চলে পা দুখানি ফোলা।
চায় দুটো পয়সা
ওটুকুই ভরসা
এভাবেই শেষ হবে তার পথ চলা।
                                       ( পঞ্চকলি ১৯)
আট।

তাকায় না কেউ কোন দিনও, রং যে আমার কালো
হোলির ফাগে রঙিন সাজে জ্বলছে মুখে আলো।
আজকে সবাই আমায় দেখে
উঠল মনে কোকিল ডেকে
চিরস্থায়ী হলে এ রং হতো কতই ভালো।
                                     ( পঞ্চকলি ১৯১)
নয়।

সালামত ঘরামির চিরসাথী অনটন
কাজে যদি নাই যায় ভুখা রয় পরিজন।
নিজ ঘরে চাল ফুটো
কোথা পাবে খড়কুটো
ভিজে যায় ঘরদোর নামে যেই বরিষণ।
                                     ( পঞ্চকলি ১৯৯)
দশ।

শীতে ঠান্ডা কনকনে
গ্রীষ্ম তাপ গনগনে
সই সব
নেই রব
বর্ষায় ভরসা আনে।
                  ( এই তো জীবন: পঞ্চকলি ৩১)

আমরা যখন ভারী ভারী বিষয় নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছি তখন এই ছোট্ট ছোট্ট স্বকীয়তায় উজ্জ্বল কবিতাগুলি সরলতার এক মায়া সৃষ্টি করে গেছে নিঃসন্দেহে। কবিকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি আশা রাখবো,'পঞ্চকলি'র আগামী কবিতাগুলি আরও আরও উৎকর্ষতা পাবে এবং তারা ক্রমশ: সংখ্যায় না বড়ো হয়ে গুণে বড়ো হবে।