__________________________________
শুভবাদী ভাবনার কবি
কবি কামাল চৌধুরীর সাথে মোহন এক আড্ডা এই নিউইয়র্কেই !
--------------------------------------------------------
আগুনঝরা সেই সত্তর দশকের প্রখ্যাত কবি কামাল চৌধুরী এসেছেন নিউইয়র্কে ।
এসেছেন তাঁর চাকুরীর সুবাদে । তিনি একজন পদস্থ সম্মানিত সরকারী কর্মকর্তা । সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব । কিন্তু কবিতা প্রেমী ও সাহিত্য প্রিয় মানুষদের কাছে তাঁর পরিচয় কবি কামাল চৌধুরী । সাউথ এশিয়ান রাইটার্স ও জার্ণালিষ্ট ফোরাম এর ব্যানারে “কবি কামাল চৌধুরী’র সাথে আড্ডা” শিরোনামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় নিউইয়র্কের বাঙালীর মিলনভূমি জ্যাকসন হাইটসের হাটবাজার রেষ্টুরেন্টের পার্টি হলে ২২শে আগষ্ট রবিবার সন্ধ্যেয়। অনুষ্টানের মূল সঞ্চালক ও প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কবিরই তরুণ বয়সের একান্ত ঘনিষ্ট বন্ধু নিউইয়র্কের অতি চেনা মুখ আকবর হায়দার কিরণ । অনুষ্টানে এসেছেন কবির সাথে বাংলাদেশ থেকে সফরকারী তাঁর কিছু সহকর্মী । অনুষ্টান শুরু হবার কথা সাতটায় হলেও শুরু হতে বেজে গেলো আটটারও পরে ।
সত্তরের দশকে কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, কবিতা লিখতে চেষ্টা করছি, সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী বা দেশ পত্রিকার সাপ্তাহিক সংকলন যোগাড় করে কবিতার পাতায় হামলে পড়ছি । ধীরে ধীরে কবিতা ঢুকে যাচ্ছে মগজের কোষে কোষে । কবিতা হয়ে উঠছে এক অপ্রতিরোধ্য এক নেশাতে । তখনই পড়া শুরু কবি কামাল চৌধুরী ও তাঁর সমসাময়িক কবিদের কবিতা, সমানে পড়া চলছে রবীন্দ্র রচনাবলী থকে শুরু করে রবীন্দ্র পরবর্ত্তী পঞ্চ পাণ্ডবের কবিতা, সমসাময়িক সব কবিদেরই কবিতা, কবি শহীদ কাদরী থেকে শামসুর রহমান, আল মাহমুদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আবুল হাসান, মোহাম্মদ রফিক, নূরুল হুদা, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ থেকে হেলাল হাফিজ, কামাল চৌধুরী, । একটা একটা কবিতা হয়ে উঠছে যেন আগ্রাসী মাদক দ্রব্যের মতো, পড়ি আর বুঁদ হয়ে থাকি, সতীর্থ কবিতা প্রিয় বন্ধুদের সাথে আলোচনায় মাতি, সেই আলোচনায় রাত বয়ে যায়, খিদে তৃষ্ণা ভুলে যাই, তবু যেন তৃপ্তি হয় না ।
তখন থেকেই কবি কামাল চৌধুরী আমার কবিতামননময় গৃহের পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছেন অন্যান্য সকল কবিদেরই সাথে । তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মিছিলের সমান বয়সী’ দোলা জাগিয়েছিল পাঠক সমাজে । সাবলীল আত্মমগ্ন ভাষার দোলায় তিনি পাঠককে নিয়ে যান এক স্বপ্নিল মায়ায় ।
আমার চিরকালের স্বভাব অনুযায়ী অনুষ্টানস্থলে পৌঁছে গেলাম সাতটা বাজার দশ মিনিট আগে । কিন্তু হল তখনও উন্মুক্ত নয়, কিছুক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করে যখন এলাম নেমে হলে, তখন দেখি শুধুই কিরণ সাহেব বসে আছেন একা । এর কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে আসতে শুরু করলেন নিউইয়র্কের কবি, সাহিত্যিক ও সাহিত্যপ্রেমীরা । কবি আসতেই হল ঘর পূর্ণ হয়ে ঊঠলো । প্রাথমিক ভাবে কেউ কেউ কবির কবিতা পড়লেন, কবিকে নিয়ে বললেন তাঁর কিছু ঘনিষ্ট বন্ধু ।
রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি কখন তিনি বলতে শুরু করবেন । রাত নয়টা বেজে গেলো তিনি বলতে শুরু করলেন । কবিতা কেন ও কবিতা কি – এই নিয়ে বলতে শুরু করে তিনি শ্রোতা দর্শকদের নিয়ে গেলেন অকস্মাৎ এক বেদনাবাহী গল্পে, যে বেদনা কবি নিয়ত বয়ে বেড়ান তাঁর অন্তরে অন্তরে । তিনি বলেন, মাতৃগর্ভে তিনি ছিলেন যমজ শিশু, জন্মের পরে তিনি বেঁচে গেলেন, কিন্তু জমজ ভাইটি বাঁচলো না । কবি মনে করেন তিনি কখনো হয়তো কবি হতেন না, সেই জমজ ভাইটিই হয়তো কবি হতো, কিন্তু সেই ভাইই তাঁর হাতে তুলে দিয়ে গেছেন কবিতা লেখার কলম, তাই তিনি লিখে চলেছেন । এক গভীর বেদনার ভারে মন বিষন্ন হয়ে গেল, পরমুহূর্তেই তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন কবিতার সেই চিরায়ত স্বপ্নিল ভূমিতে, বোদলেয়র থেকে আজকের আমেরিকান কবিদের যোগসূত্র টানলেন । বললেন, একজন কবি চিরকালই অতৃপ্ত, একজন কবির সবসময়েই মনে হবে, আসল কবিতাটি এখনো লেখা হয় নি । যেদিন একজন কবি মনে করবেন তিনি কবিতাকে ছুঁয়ে ফেলেছেন, লিখে ফেলেছেন সার্থক কবিতা, সেই মুহূর্তেই তিনি আর কবি নন । তাঁর কাব্য প্রতিভার অবসান সেখানেই । একজনের অমূলক প্রশ্নের উত্তরে তাঁকে খুলেই বলতে হলো, কবিতাই তাঁর প্রেমিকা ।
“কামাল চৌধুরী উদার মানবতাবাদে গভীরভাবে বিশ্বাসী কবি। তাঁর কবিতায় মানবতবাদী সুর প্রবল, তবে তা প্রগলভ নয়। আধুনিক কবি হয়েও তিনি শিল্পের অমানবিকীকরণ তত্ত্বে গা ভাসিয়ে দেননি। নিবিড়ভাবে মানবতাবাদী এই কবি বলেছেন- ‘‘হানাহানি, রক্তপাত- একবিশ্বে বিভক্ত পৃথিবী/কবি তার অংশ নয়- তার নাম চিরমুক্ত পাখি/জন্ম যদি চুরুলিয়া মৃত্যু তবে ঢাকার মাটিতে/কবিকে রুখতে পারে এরকম কাঁটাতার নেই।’’ যা কিছু পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর, যা সুন্দর জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক, তার পক্ষাবলম্বনে আগাগোড়াই দ্বিধাহীন তাঁর মন ও কলম। এক শুভবাদী রোদ-জোছনার মিছিল কামাল চৌধুরীর কবিতা যা দেখে পিছু হটে জীবনের যাবতীয় অশুভ অন্ধকার। শুভবাদী ঘোষণায় তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জন্মের কাছে, জন্মভূমির কাছে, পৃথিবীর কাছে”।
“প্রতিটি মুহূর্ত আমি পাখিদের জন্য লিখে দেব/পত্র ও পুষ্পবীথি, অন্ধকার, খোলা বাতায়ন/ডাকো হে আকাশ ডাকো; চিৎকারে, ক্রন্দনে, ঘৃণায়/শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাতে- এ শ্রাবণে আমি ঘুমাব না।” কামাল চৌধুরীর এই জোছনার মিছিল চুমু খেতে চায় গাছপালার পাতায়, নদীর স্রোতে, আকাশের নীলে, বলাকার ডানায়, বসতির ঝুপড়িতে, অট্টালিকার ছাদে, পথপাশের ঘাসে, পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণায়, কবিতায় খাতায় এবং আমাদের ভাবনার বাতাবরণে। বিমানবিকীকরণভিত্তিক আধুনিকতা নয়, পৌরুষহীন উত্তরাধুনিকতাও নয়, এক উত্তর-উনিবেশবাদী আলোকের প্রার্থনায় প্রতিটি শব্দকে উদার অলৌকিক হাতিয়ার হয়ে উঠতে বলে কামাল চৌধুরী কবিতা” (আমিনুল ইসলামের ভোরের কাগজে লেখা থেকে উদ্ধৃতি)।
সাম্প্রতিককালে নিজের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কবি বলেন, “আমি কবিতাপথের অতৃপ্ত যাত্রী। কবির কাজ আরাধ্য কবিতার জন্য দিগন্ত অভিমুখে যাত্রা। তিনি দিগন্তের কাছে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করবেন; কিন্তু দিগন্তকে স্পর্শ করবেন না। এ অতৃপ্তি ও স্পর্শ করার আকাঙ্ক্ষাই কবিকে আরেকটি কবিতা লেখার প্রেরণা জোগাবে। এই যাত্রাপথে অনেক ক্ষুদ্র, তুচ্ছ ও মহৎ ঘটনার সঙ্গে কবি পরিচিত হবেন। কিন্তু কোনটি কবিতার জন্য জরুরি, এর কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। কোন ঘটনা বা অনুষঙ্গ কবির মানসলোকে কবিতা হয়ে উঠবে, কবিও তা আগাম উপলব্ধি করতে পারেন না। তবে কোনো কোনো ঘটনা কবির অভিজ্ঞতায় আলাদাভাবে রেখাপাত করে। তাৎক্ষণিকভাবে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে, কিংবা সেটি ঘুমিয়ে থাকতে পারে সুপ্ত কোনো আগ্নেয়গিরির মতো। হয়তো বহুদিন বহুরাত্রি পর সেইসব অভিজ্ঞতা ও অনুষঙ্গ কবিতাময় হয়ে কবিকে প্লাবিত করবে। কবির খাতা ভরে উঠবে বর্ণমালার নানা রঙে, অক্ষরের তূর্যবাদনে।--- শব্দ ব্যবহার ও আঙ্গিককে আমি গুরুত্ব দিই। সেই সঙ্গে রহস্যময়তার একটি জায়গাও তৈরি করতে চেয়েছি, যেখানে প্রকৃত পাঠক তার অনুভব ও উপলব্ধিকে উজ্জীবিত করতে পারেন। কবিতা যে তাঁর কাছে কি, তা তিনি নীচের কবিতায় বলতে চেয়েছেনঃ
____________
আরাধ্য
____________
কোনো ভনিতা ছাড়াই তোমাকে উৎসর্গ করেছি কোলাহল
উদাস দুপুরে পাতা ঝরার দৃশ্যে আমি রচনা করিনি
শান্ত সমাহিত বটবৃক্ষের স্তোত্র
যে মুখোশে বেঁচে থাকবার কথা সেখানে বৃষ্টি
এসে তুলকালাম ঘটে গেছে রঙে
ইচ্ছুক ও অনিচ্ছুক অবগাহনের শেষে
স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নিজের ভেতরের কম্পন
ভালোবাসার মতো একটা দেশ আছে, তার ভাষায় আমি
চিৎকার করি
এই কোলাহলই আমার প্রতিদিনকার আরাধ্য কবিতা।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ কবি কামাল চৌধুরী, এই সন্ধ্যাটিকে শুদ্ধ কবিতার আবহে মোহনীয় করে তোলার জন্যে । শুভ কামনা আপনার জন্যে, ভালো থাকুন আপনি, কবিতা প্রেমীরা যেনো পায় আপনার আরো আরো অনেক কবিতা ভবিষ্যতে । কিরণ সাহেবকে ধন্যবাদ এই সুন্দর আয়োজনের জন্যে ।