-------------------------
ঝড়বাদলের রাতে ধুবলার চরের শ্মশান
পেরিয়ে এসেছিলে সেদিন তুমি এক নিমেষের জন্যে;
তোমার চোখে ভয় ছিল না, শঙ্কাও ছিলো না ।
তোমার চোখে সেই মাঝরাত্তিরে কি দেখেছিলাম
সে একমাত্র আমিই জানি । আমার তখন তেরো ব্ছর !
বাবাকে আমার মনেই নেই, মা তোমার চিন্তায় অধীর !
আশৈশব তুমিই ছিলে আমার বটবৃক্ষ । আমার অগ্রজ ।
আমার চেয়ে দশ বছরের বড়ো ছিলে তুমি;
ছোটবেলা থেকে তুমিই আমায় শিখিয়েছ
জীবনের সমূহ পাঠ, মার্ক্স এর সাম্যের সূত্র
নজরুলের শেকল ভাঙার গান, সুকান্তের কবিতা !
জানলায় ঠক ঠক, কে, কে ওখানে !
মা চিৎকার করে উঠেছিলো, মাকে বলেছিলাম,
ও কেউ নয় মা - ঝড়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছো না !
আমাদের অসুস্থ মা ঘুমিয়ে পড়েছিলো তারপর ।
মা জানে, তুমি শহরে আটকে আছো -
ফিরতে পারছো না, মা জানে না, তুমি মুক্তিযুদ্ধে গেছো!
আমি সাবধানে গিয়ে আলতো দরজা খুলতেই
তুমি সটান ঘরের ভেতর, আহ, ভিজে একসা !
আমি জানি, তোমার খুব খিদে পেয়েছিলো
চিড়েমুড়ি আর একটু গুড় এগিয়ে দিয়েছিলাম
তুমি গোগ্রাসে খাচ্ছিলে, কতদিন খাওনি কিছুই,
আমি অবাক বিস্ময়ে তোমার খাওয়া দেখছিলাম !
কে তুমি, তুমি আসলে কে ? আমি কি তোমাকে চিনি ?
তুমি বলেছিলে, আমি তোমার দাদাভাই শুধু নই
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, দেশের সৈনিক,
আমিই ফিদেল ক্যাস্ট্রো, আমিই চে গুয়েভারা
আমিই মাও সে তুঙ, আমিই লেনিন, নিপীড়িত জনতা !
সকালে ওসমান বলেছিলো তুমি আসবে রাতে,
আমি অপেক্ষা করেছি তোমার জন্যে সারাটিরাত ।
তুমি এসেছিলে একনিমেষের জন্যে, তারপরই উধাও ।
আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমিও যেতে চাই
তোমার সাথে যুদ্ধে, আমিও দেশের জন্যে লড়তে চাই ।
তুমি আমার দিকে না তাকিয়ে, খেতে খেতে বলেছিলে
তোমার এখনো সময় হয় নি, আরেকটু বড় হও ।
এরপর দেশ স্বাধীন হয়েছে,
লক্ষ লাশের পাহাড় পেরিয়ে
একটি লালসবুজ পতাকা
পত পত করে উড়ছে চারিদিকে -,
আমার ছোট্ট হাতের মুঠোয়ও
একটি লাল সবুজের পতাকা, উড়ছে, উড়ছে !
অনেক কষ্টে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কিনেছিলাম ।
দিনের পরে দিন আমি মা'কে নিয়ে তোমার অপেক্ষায়
বসেছিলাম সেই উঁচু টিলার ওপরে ।
কতজনেই ফিরে এলো, শুধু তুমিই আসো নি ফিরে ।
মা আরো দূর্বল হতে হতে বাবার কাছেই চলে গেলো ।
তোমার আর ফেরার সময় হলো না !
তুমি ফিরে এলে না বলে আজ
এই দেশটিতে ঘাতক শকুনের দল
সাপের মতো কিলবিল করছে চারিদিকে,
তুমি ফিরে এলে না বলেই আজ
খুনী ধর্ষক রাজাকারের গাড়িতে লালসবুজ পতাকা ওড়ে
তুমি ফিরে এলে না বলেই আজ
সারা দেশ জুড়ে অসৎ রাজনীতিক নামের বিচ্ছু গুলো
দেশের নিরীহ মানুষের হিস্যা
কেড়ে নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে ।
চারিদিকে কত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার দেখি
কিন্তু, একজনও মুক্তিযোদ্ধা দেখি না কোথাও !
আমি আজ অনেক বড়ো হয়েছি দাদাভাই,
আমার কি এখনও যুদ্ধে যাবার সময় হয়নি বলো !
তোমার অপেক্ষায় আমি বসে আছি সহস্র বছর
তোমার আসার সময় হবে কখন -
একটু জানিও আমাকে সময় করে ।
------/\------
[ আমার প্রিয় মুক্তিযোদ্ধা এক বড়ভাই এর স্মরণে এই লেখাটি, সত্যকথনই মূলতঃ, কবিতা করে তোলা যায় নি সঠিক ভাবে - আবেগের আতিশয্যে ]