____________
দুপুর পেরিয়ে গেছে, ঝিম ঝিম করছে চারিদিক, দূরে কোথাও কারো এক চঞ্চল কুকুর এমন হতচ্ছাড়া দুপুরের বিষন্নতা কাটাতে একটানা ঘেউ ঘেউ করে চলেছে তো চলেছেই । থামার যেনো নামই নেই । ধরণীর এই প্রান্তে শীতের কামড় এখনো বেশ তীব্র । কুকুরটার একঘেয়ে ডাকটিকে এড়ানো যাবে না জেনেই মন যেন তৈরী হয়ে আছে অবহেলার কৌশলে মানিয়ে নেবার তালে ।

অকস্মাৎ ডিংডঙ বেজে ওঠলো ডোরবেল, এমন অসময়ে কে রে বাবা ! একান্ত অনিচ্ছায় উঠতেই হলো । দরজা খুলতেই দেখি, দাঁড়িয়ে আছেন বিশেষ ডাক সরবরাহকারী । হাতে একটি প্যাকেট । ক'দিন আগেই বাংলাদেশের বইমেলা ও কোলকাতার বইমেলায় সদ্য প্রকাশিত কিছু বইয়ের অর্ডার দিয়েছি অনলাইনে । তারই কোনটা হবে হয়তো ।

এই প্রবাসে কিছু বইয়ের দোকান আছে বটে, কিন্তু সেখানে নতুন প্রকাশিত বা কাঙখিত বইটি প্রায়ই মিলে না । গলাকাটা দাম তো আছেই । বিগত চল্লিশ বছর ধরে দেশ পত্রিকা পড়বার একমাত্র নেশাটিকে ধরে রাখার জন্যে এই বিভূ্ঁইয়ে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি, যে দেশ পত্রিকার দাম কোলকাতায় পঁচিশ টাকা তা এইখানে কিনতে হয় দুইশত টাকা দিয়ে । বইয়ের যা দাম, তার দশগুণ হচ্ছে ডাকের খরচ । তবুও বছর ফিরতি বইমেলার কিছু বই নিতেই হয় । নইলে প্রাণ যে মানে না ।

ডাকের কুপন সই করে ঘরে ফিরে দেখি, খামের উপরে লেখা প্রেরক -বইমেলা ডট কম; মানে ঢাকা থেকেই এসেছে, একুশে বইমেলার বই । একটু অতি আগ্রহে তড়বড় করে ছিঁড়েই ফেললাম খামটি, যা মূলতঃ আমার স্বভাব বিরুদ্ধ । আহা- খামের ভেতর থেকে লজ্জাবতী নববধূর মতোই আলগোছে উঁকি দিচ্ছে সেই অনন্ত: অপেক্ষার বইটি - 'শতরূপে ভালোবাসা' ।

মলাটটি হয়েছে অপরূপ, বাংলা কবিতা আসরের অনেক কবির শতেক ভালোবাসার কবিতা এর মধ্যে উছল নদী হয়ে আছে জানা ছিল - কিন্তু সেই উচ্ছ্বলতার তীব্রতা যে কতখানি তা জানা ছিল না । মলাটের রঙ নববধূর বেণারসী শাড়ির মতোই মনটি উদাস-চঞ্চল করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট । স্নেহভাজন এডমিন যুগল- পল্লব ও মৌ কে মনে মনে এক পশলা ধন্যবাদ দিয়ে দিলুম । এমন আন্তরিক ও ঝকঝকে ভালোবাসার উপঢৌকনটি এমন মধুর কলেবরে সাজানোর জন্যে ।

দুজনের প্রাককথামালা 'প্রারম্ভিকা' অত্যন্ত আন্তরিক ও প্রাঞ্জল উপস্থাপনা । দুজনকেই আন্তরিক অভিনন্দন ও ভালোবাসা । আসরের অন্যতম জনপ্রিয় কবি জনাব বোদরুল আলমের মলাটগত ভূমিকাখানি এমনই আকর্ষক হয়েছে যে, পড়েই কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে ছিলুম ।  ইতিপূর্ব্বেও আমি বোদরুল সাহেব কে অনুরোধ করেছি, বড়মাপের কোন কাজে হাত দিতে । তাঁর লেখার মুন্সীয়ানা যে কোন স্তরের পাঠককে অবলীলায় লেখায় টেনে নিতে পারে, বুঁদ করে রাখতে পারে।

কুকুরটি কি এখনো ডাকছে !
ডাকছে হয়তো, কিন্তু আমার কানে আর এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন শব্দই প্রবেশ করছে না, মন ডুবে গেছে একের পর এক কবিতার গভীরে । প্রথম থেকে শেষ একটানা একশতটি কবিতাই পড়ে গেলাম যেন ঘোরের মধ্যে । আসরের সকল স্বজন বন্ধুদের কবিতা ! প্রিয় সকল মানুষের, কবির কবিতা । আমরা যারা এই আসরের সদস্য, নিত্যদিন ভাবে, ভাবনায় ও কবিতায় একে অপরকে জানি, চিনি, ডাকি, ভাবি -- তাঁদের অনেকেরই লেখা ছুঁয়ে দেখতে পারছি মমতাষ্পৃষ্ট হাতে । আরো যাদের লেখা পেলাম না, তাঁদের জন্যে মন কেমন করা ভাবটি মনে রয়েই গেলো, ভবিষ্যতের একটি উদ্যোগের কথা শুনতে পাচ্ছি । ওতে হয়তো তাঁদের লেখা প্রকাশিত হবে ।

আসরের সবাইকে আন্তরিক অভিবাদন, গভীর ভালোবাসা  ও শুভেচ্ছা জানাই । আসরে আছি আমরা যৌথ পরিবারের মতোই - ভাবনার নিত্য আদানপ্রদানে, মোহন শব্দের, কবিতার মোহমুদ্গর জালে আবদ্ধ হয়ে । সুপ্রিয় এডমিন যুগলকে জানাই আন্তরিক অভিবাদন- এমন সফল প্রকাশনার জন্যে ! আর যাঁরা এর প্রকাশনার উদ্যোগে সহায়তা করার সৌভাগ্যে সৌভাগ্যান্বিত হয়েছেন তাঁদেরকেও জানাই আন্তরিক অভিবাদন ।  মনে মনে আমিও আপনাদের সাথেই ছিলাম সেই  ফেব্রুয়ারীর প্রকাশনা উৎসবে - একুশে বইমেলায় - ঢাকায় । আপনারা সৌভাগ্যবান যাঁরা স্বশরীরে সেখানে ছিলেন । প্রতিবছর বইমেলায় মনে মনে তিরিশটি দিন মন পড়ে থাকে সেইখানে ।  

শুধু গভীর এ ব্যথাটুকু মনে- এবারের বই মেলায় অতি নির্মমভাবে মুক্তচিন্তার এক নক্ষত্রকে শুধু মুক্তচিন্তার ধারক বলেই প্রাণ দিতে হলো - রঞ্জিত হলো সেই কাব্যতীর্থভূমি অভিজিৎ এর তাজা রক্তে । যেমন হয়েছিল একইভাবে ক'বছর আগে সব্যসাচী লেখক হুমায়ূন আজাদের ক্ষেত্রেও ।

সকল মুক্তচিন্তার পথিকদেরই প্রাণের আকুতি ও প্রার্থনা রইলো - এই গভীর আঁধার যেনো মুছে যায় - মুছে যায়  অচিরে । 'শতরূপে ভালোবাসা' যেনো ছড়িয়ে ছড়িয়ে পরে সকল প্রাণের উৎসারে ।