*********    
     দিন যেনো আর ফুরোতেই চায় না । গ্রীষ্মের বন্ধে সকুল কলেজ সব ছুটি । আর এখানকার গ্রীষ্মের বন্ধটিও এক বিশাল ব্যাপার । টানা আড়াইমাস ছুটি । এবারে উত্তর আমেরিকার এই দিকটাতে গরম একেবারে পড়েনি বললে ভুল হবে না । এমন গরমহীন গ্রীষ্ম আর আগে দেখা যায় নি । ছেলে মেয়েদের সময় কাটে না তাই ওদের নিয়ে প্রায় নিত্যদিনই পার্কে যাওয়া বিকেল বেলাটায় । ওরা পার্কে খেলে আর বড়রা কেউ বই পড়ে, কেউ আইপেড বা ফোনে গুজুর গুজুর করে সময় কাটায় ।

    পার্কের বে্ঞ্চিতে এসে বসেছে একটি দেশ থেকে সদ্য আসা পরিবার । ছোট ছোট দুটি ফুলের মত শিশু ওদের সাথে । পার্কে এসেছে আরো অনেকেই । তন্মধ্যে একটি রাশিয়ান পরিবার - ওদেরও দুটি সন্তান, কিন্তু ওদের সাথে আছে ওদের বৃদ্ধ বাবা মা ।

     বাঙালী পরিবারের শিশুদের সাথে রাশিয়ান পরিবারের শিহ্সুদের কিছুক্ষণের মধ্যে ভাব হয়ে গেল । ওরা একসাথে খেলছে -- কুহ ছুটাছুটি করছে । এরই মধ্যে দুই পরিবারের মধ্যে চলছে ভাবের আদানপ্রদান । নতুন আসা বাঙালী পরিবারের ওরা এখনো ইংরাজী ভাষায় খুব সড়গড় হয়নি, তাই রাশিয়ান পরিবারের লোকদের সাথে আলাপে তেমন সুবিধা হচ্ছে না ।

     কথার ফাঁকে হঠাৎ রাশিয়ান পরিবারের বৃদ্ধ দাদুটি প্রশ্ন করে বসলেন বাঙালী পরিবারটিকে  - তোমাদের বাড়ী কোথায় ?

     --আমাদের বাড়ী বাংলাদেশে ।

     অকস্মাৎ যেনো সেখানে কেউ একটা পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছে - এমন করেই তড়াক করে ঊঠে বৃদ্ধ দাদুটি চিৎ্কার করে ওদের পরিবারের খেলতে থাকা শিশুদের ডেকে নিয়ে এলেন- আর বাঙালী পরিবারসহ পার্কের অনেককে শুনিয়ে উচ্চেস্বরে বললেন এমন একটি কথা যা শ্রোতা হিসাবে সহ্য করা খুব কঠিন ।

      বৃদ্ধটি যা বললেন, তার ভাবার্থ করলে দাঁড়ায়  এই :
ওরা ভাল মানুষ নয়, ওরা খুনীর জাত । ওরা ওদেরকে স্বাধীনতা এনে দেয়া জাতির পিতাকে হত্যা করেছে - ওরা পিতার হত্যাকারী -- খুনীর জাতের সাথে তোমরা খেলতে পারো না। তোমাদের শরীর অপবিত্র হয়ে যাবে !!

        বাঙালী পরিবারটি সব কথা ঠিক মত বুঝলো কি বুঝলো না -- তবু বুঝলো যে ওদের জাতির পিতার খুনী ডাকা হচ্ছে -- !! অবস্থা অনুমান করতে পেরে বাঙালী পরিবারটি সবার উৎসুক দৃষ্টি পার হয়ে ধীরে ধীরে ওদের বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেলেন পার্ক ছেড়ে । ওদের বেদনাহত চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া অন্যদের কিছুই করার ছিলো না - ব্যাপারটা এতই নাটকীয়ভাবে হলো যে, অন্য কেউ কথা বলতে গেলেই পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠবে এই ভয়ে কেউ কিছুই বললো না । আর এখানে সাধারণত; গায়ে পড়ে কেউ নাক গলায় না ।

       জাতির পিতার হত্যাকারী বাংলাদেশের সবাই তো নয়, তবু এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দায়ভার এই বিদেশের মাটিতেই একটি নিরীহ পরিবারকে চুপচাপ বয়ে নিতে হলো - । ইতিহাসের কী নির্মম শোধ । যারা হত্যাকারী তার বহাল তবিয়তে সারা বিশ্বে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে - স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী ও পাকি বর্বরদের সাথে হাত মেলানো রাজাকার আলবদরেরাও পুনর্বাসন পেয়ে দেশে মন্ত্রী প্রেসিডেন্টও হয়ে গেলো । কিন্তু বিশ্বের আনাচে কানাচে এখনো বাংলাদেশী পরিচয় প্রদানকারীরা পিতার হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত হয় -- লজ্জায় হেঁট হয়ে আসে মাথা ।

      আজ চল্লিশ বছর পরেও এই লজ্জার শেষ হয় নি - আজো বঙ্গবন্ধুর খুনীরা বেঁচে আছে এই পৃথিবীর মাটিতে - এর চেয়ে বড় লজ্জার কালিমা বাঙালীর জন্যে আর কী হতে পারে  !!


[দ্র: এটি একটি সত্য ঘটনা- বাঙালী পরিবারটির কাছেই শোনা ।]