******************

              কবি আবুল হোসেন শুধু বাংলা ভাষার একজন কবির নামই শুধু নয়, সে এক এমন কবিরই নাম যিনি বাংলাভাষী, বাঙালীদের এক গৌরবময় অহঙ্কারের নাম, এক ঋদ্ধ আধুনিক কবিরই নাম, এক অনন্ত আলোকামালায় বাংলা কবিতাকে নতুন রূপদানকারীরই নাম । গত ছাব্বিশে জুন  বিরানব্বই বছর বয়সে তিনি ছেড়েই গেলেন তাঁর স্বপ্নভুবন – নববসন্তের ফুলেল বাগান । কবিতা নিয়ে বিতর্কে তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকেও আকৃষ্ট করেছিলেন কিশোরোত্তীর্ণ বয়সেরই রচনা দিয়ে ।

               কবিগুরুর সাথে তাঁর সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল, সুযোগ হয়েছিল বাংলার জাতীয় কবি কাজী নজরুলের সাথে গভীর সখ্যতার । জানতেন কবি জীবনানন্দকে খুউব কাছ থেকেই । বাংলাদেশের বাগেরহাটের এক স্বপ্নিল গ্রামে তাঁর জন্ম হয়েছিলো । বেড়ে উঠেছিলেন ওপার বাংলায়, দেশভাগের পরে এসেছিলেন ফিরে আয়কর বিভাগের চাকরি নিয়ে, অতঃপর জীবনের নানান মোড়ের বাঁকে ঘুরে নিয়েছিলেন সচিবালয়ের চাকরি । কিন্তু তাঁর অন্তর জুড়েই ছিলো কবিতার অমল প্রবাহ । তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নববসন্ত’ প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে । কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই দুই বাংলার সাহিত্যানুরাগী ও কবিদের মধ্যে এক আলোড়ন তুলে, তাঁর কবিতায় আধুনিকতার অপূর্ব দ্যূতিতে । অসংখ্য সাময়িকী  ও পত্রিকায় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের উপরে অত্যন্ত উচ্চ প্রশংসা সম্বলিত আলোচনা প্রকাশিত হয় ।

           কল্লোলযুগের প্রায় সমসাময়িক হলে ও তিনি স্বতন্ত্র হবার সাধনায় নিজের একক বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্টা করতে সক্ষম হয়েছিলেন । তাঁর কবিতা মূলতঃ গদ্য কবিতাই । তবে অনেক পদ্য কবিতা বা অন্ত্যঃমিলের কবিতাও লিখেছেন বৈকি । কবিতা গদ্য হোক, পদ্য হোক তাতে কোন তফাৎ নেই – সেই সত্য প্রমাণ করতে তিনি কবিগুরুর সাথেও বিতর্কে মেতেছিলেন । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও গদ্য কবিতা লেখায় হাত দিয়েছিলে্‌ যিনি মূলতঃ মনে করতেন পদ্য কবিতাই আসল কবিতা । তিনি আজীবন তাঁর প্রাণের গভীরে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ কে লালন করেছেন । তাঁরও বিশেষ প্রেরণার ও পছন্দের কবি ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ ।

          অন্তরে তিনি চিরনবীন ছিলেন, কবিতা লিখে গেছেন শেষের দিনের কাছাকাছি সময়েও  এবং বিস্ময়করভাবে সেই কবিতারও উজ্জ্বলতায় একটুও কমতি ছিলো না ! তিনি নেই – কিন্তু তাঁর কবিতা হয়ে তিনি আমাদের সাথে আছেন, থাকবেন চিরকাল ।

         আসরের পাঠকদের জন্যে তাঁর অনতিদূর সাম্প্রতিক কালে লেখা একটি পদ্য কবিতাই তুলে দিলাম, যা মাত্র চার বছর আগেই প্রকাশিত হয়েছে ।

কবি আবুল হোসেন এর কবিতা
_____________
** শেষ কথা **
_______________
যখন সকল কথা শেষ হয়ে যায়
না-বলা কথার ভার মূক স্তব্ধতায়
কাঁপে ভীরু প্রদীপের শিখার মতন।
দিনে যত আনাগোনা
কথা দিয়ে জাল বোনা
থেমে যায় একদিন হঠাৎ কখন।
থামে না তো স্রোত,শুধু
সরে যায় ঘোলা জল।
কাটে না তো সুর,শুধু
পড়ে যায় ঝরা দল।
তখন হূদয়ে নামে ভোরের আকাশ
পাখা মেলে বুনো বালিহাঁস,
সকালের রোদ গায়
কালো মেঘ ছেড়ে যায়
ভুলে গেছে বাসা তার
জানে শুধু সে সাঁতার।
_____________
    
          আমাদের অহংকার কবি আবুল হোসেনের প্রয়াণে আমরা শোকসন্তপ্ত, কিন্তু আমরা জানি তিনি আমাদের সাথে আছেন দিন ও রাত্রি, তিনি আমাদের সাথেই আছেন তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে । বাংলা কবিতা আসরের সকল কবি ও পাঠকদের পক্ষ হতে আমরা তাঁর প্রতি নিবেদন করি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী। প্রিয় কবি – আমরা জানি  তুমি আছো আমাদের সাথে – কারণ আমরা জানি কবির কখনো মৃত্যু হয় না ।