*************
              কবি জীবনানন্দ দাশ এর কবিতায় চিত্রকল্পএর সাথে সাথে এক গভীর দর্শনের বক্তব্যও যেন কবি খুউব সুনিপুণতার সাথে শব্দের ভাঁজে ভাঁজে চারিয়ে দিয়েছেন, সেই দর্শন জীবনের দর্শন, সেই দর্শন আত্মবীক্ষণের দর্শন, সেই দর্শন এই মায়াময় ক্ষণিকের পৃথিবীর প্রতি গাঢ় এক ভালবাসার অব্যক্ত দর্শন ।
সাহিত্য সমালোচক মহিউদ্দীন মোহাম্মদ তাঁর  ‘জীবনানন্দের কবিতায় চিত্রকল্পঃ সৌন্দর্য ও নিরাকরণের স্বাদ’ প্রবন্ধে  উল্লেখ করেছেন কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে যে, “‘অবসরের গান’ কবিতার শুরুতেই ইন্দ্রিয়ঘন উপমা-আশ্রিত চিত্রকল্পে বিস্ময় জাগে। ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/অলস গেঁয়োর মত এই খানে কার্তিকের ক্ষেতে;/মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার,—চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ’ পুরো তিন পঙিক্তজুড়েই একটি চিত্রকল্প উজ্জ্বল হয়ে আছে। স্বাদের অবাস্তব রূপের সঙ্গে বাস্তব জগতের সম্মিলন। অলীক উপলব্ধির সংশ্লেষ ঘটানোর অভিনব কৌশলও। যার নাম হয়তো প্রকারান্তরে পরাবাস্তবও হতে পারে। কিন্তু এখানে পরাবাস্তবতা খুঁজে পেতে গেলে বাস্তবতারও সংশ্লেষ ঘটাতে হয়। কার্তিকের মাঠে মাঠে ফসলের উত্সব। কৃষকের মনে আনন্দের হিল্লোল। এতসব আনন্দের ভেতর অলস সময় কাটানোর মতো অফুরন্ত সময় পাড়াগাঁর মানুষের থাকে না। নতুনকে আহ্বান করা ও বরণ করার ভেতরই উচ্ছ্বাসপূর্ণ হয় না। পরবর্তীকালের জন্য সঞ্চয়ও মানুষের চিন্তাবর্গের অনেকটা অঞ্চলজুড়ে জায়গা করে রাখে। তাই ‘পুরোনো পেঁচারা সব কোটরের থেকে’ যখন বের হয়ে আসে অন্ধকারে তখন ‘ইঁদুরেরা চলে গেছে’। খাদ্যচক্রের প্রসঙ্গনির্ভর এ চিত্রকল্পের প্রাণীজগতের অনিবার্য সত্য চিত্রায়িত। আবার এ দৃশ্য ইয়েটসকে মনে করিয়ে দেয়। ইয়েটসেও কেবল ইঁদুর আর পেঁচার আনাগোনা। কিন্তু ইয়েটসের কবিতায় যে অর্থে প্যাস্টোরাল কবিতার গন্ধ খুঁজে পান সমালোচকরা, সে অর্থে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় কোনো গ্রাম্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। অথচ দু’জনই গ্রামের দৃশ্য এঁকেছেন।

               এ কথা সত্য যে,শিল্প পুরোপুরি সমাজ-বিমুখ নয় কিন্তু তার নিজস্ব একটি গতিধারা আছে— নিজের যুক্তিতে সে অগ্রসর হয় এবং শ্রুতিতে যে ধ্বনি সে ধারণ করে তা তার নিভৃত লোকের কণ্ঠস্বর, পৃথিবীর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কলরোল নয়। এভাবেই জীবনানন্দ দাশ এক পৃথিবী নির্মাণ করেছেন যা একান্তভাবে তাঁর নিজস্ব-জনসাধারণের নয়। জার্মান কবি রিল্কে এক তরুণ কবিকে উপদেশ দিয়েছিলেন— 'তুমি তোমার মধ্যে আত্মগোপন কর এবং যে-উৎস থেকে তোমার জীবন জেগেছে তার গভীরতা জানবার চেষ্টা কর। শিল্পী তার নিজের জন্য এক ভূখণ্ড নির্মাণ করবেন এবং আপনার মধ্যে এবং প্রকৃতির মধ্যে সকল বিস্ময়ের সন্ধান করবেন। তুমি তোমার নির্জনতাকে ভালবাসবে এবং নির্জনতার কারণে যে বেদনা সে-বেদনার নির্মম দাহনকে সহ্য করবে।' এমন পথের পথিক জীবনানন্দ রূপের রাজ্যে অবসরপ্রিয় মানুষের চোখ দেখেন ‘আকাশের মেঠোপথে থেমে ভেসে চলে চাঁদ’। কারণ ‘সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে’। শীতের শেষে বসন্ত, বসন্ত শেষ না হতেই গ্রীষ্মের আলস্য মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। অনেকটা ‘গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে’ ধরনের বার্তাও শোনা যায়।

      ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতায় চিত্রকল্পের বিপুল সমাহারে বিস্ময় জাগে। ‘আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়’ বলে সময়নির্ভর চিত্রকল্পের আশ্রয়ে কবিতার শুরু। যেখানে চাঁদ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কেবল, সেখানে জোনাকিরা অন্ধকার দূর করে দেয়। এমন শীতে ‘মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার’ শুনেও পুরনো পেঁচার ঘ্রাণের সন্ধান করে সুলুকসন্ধানী মন। অপরূপ শীতের রাতে অশত্থের ডালে ডালে বক ডেকে ওঠে। ‘বুনো হাঁস শিকারীর গুলির আঘাত’ এড়িয়ে দূরে চলে গেলে ‘সন্ধ্যার কাকের মত আকাঙ্ক্ষা’ নিয়ে নিত্যদৃশ্যে অভ্যস্ত হয় সংসারী মানুষ। সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হলুদ হয়ে এলে ‘মিনারের মত মেঘ সোনালী চিলেরে তার জানালায় ডাকে’ চিত্রকল্পে জীবনানন্দ দাশের স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায় হলেও এর ভেতরই মৃত্যুর করুণ দৃশ্যও উঁকি দেয়। তাই ‘সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মত এসে জাগে/ধূসর মৃত্যুর মুখ’ তখন মৃত্যুর আগে আরও একবার বেঁচে থাকার আকুতি জানানোর আকাঙ্ক্ষাও জাগে”।

             কবি জীবনানন্দ দাশ এর আরো একটি অসম্ভব ভালো লাগার কবিতা কলেজ জীবনে খুউব পাঠ করে আনন্দ পেতাম, আমাদের একজন খুব জীবনানন্দ-প্রিয় শিক্ষক ছিলেন, তিনি কবিতা পাগলও ছিলেন । হঠাৎ ক্লাশের মাঝখানেই লেকচার থামিয়ে বলে উঠতেন – ‘আবৃত্তি করতো ওই ‘তোমায় আমি’ কবিতাটি’ । অবাক ব্যাপার হলো, তিনি ছিলেন জীববিজ্ঞানের প্রফেসর, কিন্তু মহা এক কবিতা পাগল । সেই প্রিয় কবিতাটি তুলে দিলাম আসরে – কবিতাটির শেষে এলে এমন ভালোলাগায় আজো মন ভরে যায় – আর যেন এক দৌড়ে মন আজ হতে বহু যুগ বহু বছর পেছনে ফিরে যায় – ফিরে ফিরে চায়।

কবি জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতা
_____________
তোমায় আমি
________________
তোমায় আমি দেখেছিলাম ব’লে
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;
শিশির কণার মতন শূন্যে ঘুরে
শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে
খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।
নদী সাগর কোথায় চলে ব’য়ে
পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হ’য়ে
জানি না কিছু-দেখি না কিছু আর
এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার
পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে।
তোমায় ভালোবেসেছি আমি,তাই
শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,
তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে
চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে
শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে।
জানি আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয়
পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।
এই আছে,নেই-এই আছে নেই-জীবন চঞ্চল;
তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল
বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।

                 (চলবে)