*************
                   কবি জীবনানন্দ দাশকে অনেকেই বিষন্নতার কবি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, তাঁর সর্ব্বগ্রাসী বেদনাবোধ যেন আত্মপরিধি অতিক্রম করে এক মহাসাগরে পরিণত এবং সেই মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ যেন গ্রাস করে পাঠককেও সমানভাবে – পাঠকও গভির বেদনাবোধে তাড়িত হয় । আমার মনে হয় এইরকম ভাবনার মেরুকরণ কবি জীবনানন্দের প্রতি সঠিক সুবিচার নয় , শুধু একমাত্র কবিতা বনলতা সেন’কেও যদি ধরি – গভীর হতাশার পর এক উছল আশার আলোয় কি কবিতাটি শেষ হয় নি ?  তাঁর কবিতা জটিল, অবোধ্য, দুর্বোধ্য, উৎকট শব্দের সমাহারে অপাঠ্য এমন কত কথাই তাঁর বিরুদ্ধে উপস্থাপিত হয়েছে । কিন্তু কালের বৈতরণী বেয়ে তিনি ঠিকই এই শতাব্দীর সবচাইতে আধুনিক ও সর্ব্বাধিক পঠিত কবিতে গণ্য হয়েছেন, অবশ্য ভাগ্যের পরিহাসে –তাঁর জীবনাবসানের অনেক পরেই ।

                   সাহিত্য সমালোচক মহিউদ্দীন মোহাম্মদ তাঁর  ‘জীবনানন্দের কবিতায় চিত্রকল্পঃ সৌন্দর্য ও নিরাকরণের স্বাদ’ প্রবন্ধে আরো লিখেছেন, ‘জীবনানন্দ স্বভাবের সপক্ষে একটি জটিল সারল্যের কবিতা ‘বোধ’। সহজ-সরল বাক্যবন্ধের সম্মিলনে রচিত এ কবিতা। আপাত সরল বাক্যাবলীর মাধ্যমেই জটিল চিন্তা ঘনীভূত হয়ে উঠেছে; ধীরে ধীরে। ক্রমেই জটিলতম চিন্তার দুর্গম অঞ্চলে পরিণতি পেয়েছে। ব্যক্তি-বিশেষের স্ববিরোধ শিল্পের অঞ্চলে এক অনির্বচনীয় ঢেউয়ের নাম ‘বোধ’। ‘আলো-অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয়-কোন এক বোধ কাজ করে’, কিন্তু সে বোধ কী? সে প্রশ্নের উত্তর মেলে না। অথচ দুর্বোধ্য সে অনুভূতিপুঞ্জকেই যেন গভীর মমতায় প্রকাশ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। না পেরেই কি একা হয়ে গেলেন? ‘সকল লোকের মাঝে বসে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?/আমার চোখে শুধু ধাঁধা? আমার পথেই শুধু বাধা?’ উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এ বৈশিষ্ট্যই জীবনানন্দ দাশকে রোমান্টিক এবং সমকালীন আধুনিক কবিদের থেকেও ভিন্ন ও বিশিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট করেছে। এটিই তার মহত্তম আধুনিক কবিসত্তার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, ঘৃণা, অবহেলা— সবই একজন মানুষের মনে কী করে একীভূত হয়ে এক অব্যক্ত বেদনারাশির জন্ম দেয়,তা-ই যেন এ কবিতার মূল বিষয়ে পরিণত।

             এটি আধুনিকতাবাদের নৈরাশ্য ও নিঃসঙ্গচেতনা কিংবা বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং অলৌকিকতায় আস্থাহীনতার বৈশিষ্ট্যকে নিশ্চিতির রূপ দেয়। আপন চিত্তের চাঞ্চল্যের কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ কবি। বিস্ময় প্রকাশের ভাষা তার,‘সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়!’ তারপরই বিস্ময়াভিভূত আপন হৃদয়ের কাছেই প্রশ্ন জমা রাখেন, ‘অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?’ অসুখী মানুষ, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে সহ্য করেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার আঁকুতিই প্রকাশ করে। সাঁর্ত্রে কথিত অস্তিত্ববাদী চেতনার এ আরেক বিরল দৃষ্টান্ত। ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’র সঙ্গে ‘বোধ’ কবিতার অন্তর্গত মিলের চেয়ে অমিলই যেন বেশি। যে অর্থে ‘গোধূলী সন্ধির নৃত্য’ রাজনীতি সচেতন কবিতা, সে অর্থে ‘বোধ’ নয়। প্রথমটিতে ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির যোগাযোগকে পূর্ণ করে তোলা হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে ব্যক্তির একাকিত্ব,হাহাকারকে চাড়িয়ে দিয়েছেন মানবমনে’।

           এবারে একটি একেবারে অন্য ধাঁচের কবিতা তুলে ধরছি কবি জীবনানন্দ দাশ এর, কবিতাটির নাম ‘আকাশে চাঁদের আলো’ । এই কবিতার বিন্যাস ও শব্দপ্রকরণ দেখেও নোতুন কবিদের অনেক কিছু শেখার আছে ।

কবি জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতা
_____________
আকাশে চাঁদের আলো
*******************

আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ
বাতাসে ঘুঘুর ডাক—অশত্থে ঘুঘুর ডাক—হৃদয়ে ঘুঘু যে ডাকে—নরম ঘুঘুর ডাক আজ
তুমি যে রয়েছ কাছে—ঘাসে যে তোমার ছায়া—তোমার হাতের ছায়া—তোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ ।
২​
কেউ যে কোথাও নেই—সকলে গিয়েছে মরে—সকলে গিয়েছে চলে—উঠান রয়েছে শুধু একা
শিশুরা কাঁদে না কেউ—রুগিরা হাঁপায় না তো—বুড়োরা কয় না কথা : থুবড়ো ব্যথার কথা যত
এখানে সকাল নাই—এখানে দুপুর নাই—এখানে জনতা নাই—এখানে সমাজ নাই—নাইকো মূর্খ ধাঁধা কিছু
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ ।

আর তো ক্লান্তি নাই—নাইকো চেষ্টা আজ—নাইকো রক্ত ব্যথা—বিমূঢ় ভিড়ের থেকে নিয়েছি জীবন ভরে ছুটি
হেঁটেছি অনেক পথ—আমার ফুরালো পথ—এখানে সকল পথ তোমার পায়ের পথে গিয়েছে নীলাভ ঘাসে মুছে
তুমি যে রয়েছ কাছে—ঘাসে যে তোমার ছায়া—তোমার হাতের ছায়া—তোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ ।

               প্রথম দু’টি স্তবকে প্রথম ও শেষ দুই লাইন একই – আবার পরের দুই স্তবকের শেষ লাইনও সেই একই লাইন । অথচ প্রতিটি স্তবকে ভাবের গভীরতা ও চিত্রকল্প সৃজনের যে শৈল্পিকতা তা অনায়াসেই মনকে ছুঁয়ে  যায় এবং পাঠককে ভাবিত করে তোলে কবিতার পুরো বক্তব্য সম্পর্কেই ।


  (চলবে)