**********
        
           আমি নিজে এই আসরের বা আসরের বাইরে কাউকেই কবিতা লেখা নিয়ে পরামর্শ দেই না, দিতে চাই না । প্রথমতঃ আমি নিজেকেই এখনো কবি ভাবতে পারি না এবং আমি নিজেই নিশ্চিত নই আমি যা লিখি তা' আদৌ কবিতা হয় কিনা । আমার বিশ্বাস একটি কবিতা কিভাবে লেখা হবে তা নির্ভর করে একান্তই কবির মনের ভাবের পরিপক্কতা, সময় ও পরিবেশ, মনের গভীরতা সেই মুহুর্তে ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক সংশ্লিষ্টতা ।কবিতায় বানান ভুল হলে কেউ কেউ হয়তো সংশোধনের কথা বলে মন্তব্য করেন । আমি তাও করিনা, কারণ আমি দেখি অভ্রতে টাইপ করতে ভাল করে খেয়াল না করলে ভুল হয়ই বানান জানা থাকলেও । কবিতার সমালোচনা করতে পারেন তাঁরা যারা সত্যিকার অর্থে বড়মাপের কবি বা সাহিত্যিক ।

         কবিতার সমালোচনা নিয়ে কবি শার্ল বোদলেয়রের একটি মন্তব্যকেই আমি শেষ কথা বলে জানি-- তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হোল - ' আপনিতো এত ভাল কবিতা লিখেন - কিন্তু সমালোচকেরা তা অশ্লীল বলে নিন্দা ছড়াচ্ছে । ওদেরকে আপনার কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না ?

           কবি বোদলেয়র বললেন, ‘দেখো এ আমারই কবিতা - মনে যেমন যেভাবে আসে লিখি, কবিতা কিভাবে লিখা হবে তার কোন সঠিক নিয়ম নেই, আর দেখো - পথে যেতে কুকুরও ঘেউ ঘেউ করে, তুমি কি ওদেরকে কিছু বল? আমিও তেমনি সমালোচকদের কথায় কর্ণপাত করি না। কারণ আমার কবিতা পড়তে আমি ওদের মাথার দিব্যি দিইনি, ওরা সমালোচনাই পারে-- ওদের বলতো এক লাইন কবিতা লিখতে; পারবে না ! "  লিখতে লিখতেই একদিন অনুপম কবিতা দাঁড়িয়ে যাবে --। শুধু পড়তে হবে অনেক, চর্যাপদ থেকে আজকের জয় গোস্বামী, হেলাল হাফিজ সবাইকে - যত বেশী পারা যায় ।

       কবিতা কী,কবিতা কেমন হবে, কবিতার ভবিষ্যৎ কী— এমন কতগুলো কী'র উত্তর খোঁজার অনাবিল যাত্রায় জীবনানন্দ দাশ স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে উঠেন। তাঁর 'কবিতার কথা' নামক প্রবন্ধে এ নিয়ে তিনি নানান ব্যাখা প্রদান করেছেন। ‘বরং লেখনাকো একটি কবিতা’— এই চ্যালেঞ্জ প্রদানকারী বলছেন, 'সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি’ ! কবি— কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নবনব কাব্য-বিকীরণ তাদের সাহায্য করছে। সাহায্য করছে; কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্য প্রাপ্ত হয়; নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।'
       সেই একই প্রবন্ধেই তিনি আবারও এ কথাও বলছেন, 'হতে পারে কবিতা জীবনের নানা রকম সমস্যার উদ্ঘাটন; কিন্তু উদ্ঘাটন দার্শনিকের মতো নয; যা উদ্ঘাটিত হল তা যে কোন জঠরের থেকেই হোক আসবে সৌন্দর্যৈর রূপে, আমার কল্পনাকে তৃপ্তি দেবে; যদি তা না দেয় তাহলে উদ্ঘাটিত সিদ্ধান্ত হয়তো পুরোনো চিন্তার নতুন আবৃত্তি, কিংবা হয়তো নতুন কোনো চিন্তাও (যা হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে), কিন্তু তবু তা কবিতা হল না, হল কেবলমাত্র মনোবীজরাশি। কিন্তু সেই উদ্ঘাটন-পুরোনোর ভিতরে সেই নতুন কিংবা সেই সজীব-নতুন যদি আমার কল্পনাকে তৃপ্ত করতে পারে, আমার সৌন্দর্যবোধকে আনন্দ দিতে পারে, তাহলে তার কবিতাগত মূল্য পাওয়া গেল; আরো নানা রকম মূল্য-যে সবের কথা আগে আমি বলেছি— তার থাকতে পারে, আমার জীবনের ভিতর তা আরো খানিকটা জ্ঞানবীজের মতো ছড়াতে পারে, আমার অনুভূতির পরিধি বাড়িয়ে দিতে পারে, আমার দৃষ্টি স্থূলতাকে উঁচু মঠের মতো যেন একটা মৌন সূক্ষ্মশীর্ষ আমোদের আস্বাদ দিতে পারে; এবং কল্পনার আভায় আলোকিত হয়ে এ সমস্ত জিনিস যত বিশাল ও গভীরভাবে সে নিয়ে আসবে কবিতার প্রাচীন প্রদীপ-ততই নক্ষত্রের নতুনতম কক্ষ-পরিবর্তনের স্বীকৃতি ও আবেগের মতো জ্বলতে থাকবে।'
            কবি জীবনানন্দ দাশ এমন এক কবি যাঁর হাতে বাংলা কবিতা পেয়েছে আধুনিকতার অমল প্রাণ; আসরের কবিদের সাথে তাঁর আরেকটি কবিতা ‘ঘরের ভিতর দীপ জ্বপ্লে ওঠে সন্ধ্যায়’ শেয়ার করলাম --

ঘরের ভিতরে দীপ জ্বলে ওঠে সন্ধ্যায়
_____________________
ঘরের ভিতরে দীপ জ্বলে ওঠে সন্ধ্যায়—ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয়
ভিজে চালে ডুমুরের পাতা ঝরে—শালিখ বসিয়া থাকে মুহূর্ত সময়
জানালার কাছে এসে, ভিজে জানালার কাছে
মৌমাছি বহুক্ষণ মৃদু গুমরায়
এইসব ভালো লাগে : এইসব ম্লান গন্ধ মৃদু স্বাদ চায়
পৃথিবীর পথে ঘুরে আমার হৃদয়
ডুমুরের পাতা ঝরে ভিজে চালে—ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয়
মলিন শাড়ির ঘ্রাণ ধূপ হাতে দুয়ারে দাঁড়ায়।
এইসব ভালোবাসি—জীবনের পথে ঘুরে
এইসব ভালোবাসে আমার হৃদয়
ঘরে আলো, বৃষ্টি ক্ষান্ত হ’ল সন্ধ্যায়
ঘরের দীপ জ্বলে ওঠে, ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয়
ভিজে চালে কদমের পাতা ঝরে—শালিক বসিয়া থাকে মুহূর্ত সময়
মলিন শাড়ির ঘ্রাণ ধূপ হাতে দুয়ারে দাঁড়ায়
মৃদু আরো মৃদু হয়ে অবিরল বাতাসে হারায়।।
         -এই কবিতায়ও দেখা যায় কী অপরূপভাবে বৃষ্টির পরে ডুমুরের পাতা ঝরা, শালিখ আসে জানলায়, মৌমাছিও আসে -এক অনাবিল নষ্টালজিয়া এসে কবিতাকে মেদুর করে দেয় – পড়তে পড়তে কোন গহীন গাঁয়ের এক ভক্তিমতী বধূ মলিন শাড়িতে ধূপ নিয়ে দাঁড়ানোর অনুপম ছবি ভেসে ওঠে – আর মন ভরে ওঠে এক অপার্থিব আনন্দে ।
                                                 (চলবে)