**********
          
       এক গভীর অস্থির সময়ের যাঁতাকলের মধ্যেই কবি জীবনানন্দ দাশ এর জীবন ও কবিতা প্রবাহিত হয়ে চলেছিলো । চারিদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা, চরম দূর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা – কী না তিনি দেখেছেন, মোকাবেলা করেছেন জীবনের পরতে পরতে এই সব দুঃসময়ের কালো তীরকে ।
     ‘হ্যারিসন রোডে আরও গভীর অসুখ’ প্রবন্ধে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় লিখছেন,  ‘তিরিশ দশকের সময় থেকে জীবনানন্দ দাশের কাব্যে শহরের উপাখ্যান লক্ষ করা গেল। প্রথমদিকে শহরের কাব্যে তিনি গ্রামকে সন্নিবিষ্ট দেখতে পারতেন; পরে গ্রাম ক্রমশই বিমূর্ত সঙ্কেতে পুনর্জিত হতে শুরু করে। তাঁর এই শহরবাসের ইতিকথায় নানা পর্ব-বিভাজন আছে। আমরা শুধু দেখতে চাইব কী করে বনলতা সেন-এর 'পথ হাঁটা' কবিতা থেকে জীবনানন্দের মধ্যে একটি শাহরিক পরিব্রাজনার চরিত্র তৈরী হল। এই চলমান পরিক্রমা যে ধরনের দৃষ্টি সংগঠন করে তাতে একধরনের রেটরিক অব ওয়াকিং বা পায়ে হাঁটার অলঙ্কারশাস্ত্র রচিত হয়। এই দর্শক যে নিজেকে ভিড়ের হৃদয় থেকে অচিহ্নিত করে অথচ ভিড়কে নথিভুক্ত করে, আমাদের সমালোচনা তত্ত্ব তাকে ফ্ল্যানেরি নামে নির্দেশ করেছে। যেমন উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী প্যারিসে বোদলেয়ারের বিখ্যাত নৈশভ্রমণও আমাদের আধুনিকতার উপত্যকাটিকে স্পষ্ট করে দেয়, জীবনানন্দের পর্যটনব্রত সে-রকমই ইতিহাস সম্পর্কিত একটি ধারণার উন্মোচন। এই শতাব্দীর প্রথমদিকে রদ্যাঁর সচিব থাকার সময়ে আরেক মহাকবি রিলকে প্যারিসের পথ পরিক্রমায় যে ত্রাস ও বিস্ময় অনুভব করেছেন তা লিপিবদ্ধ আছে তাঁর পত্রাবলি ও একমাত্র উপন্যাস মাল্টে ব্রিগগের নোটবুকে। জীবনানন্দ এমন নয় যে বোদলেয়ার বা রিলকের অন্তর্যামী গ্রাহক কিন্তু আমি পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি নিয়েই বলব আমাদের কাব্যে ও গদ্যে তাঁর উপস্থিতি সম্পূর্ণ গুণগত উত্তরণ। রবীন্দ্র বিরোধিতা তো একটি তুচ্ছ উপলক্ষ; সন্দেহ নেই তুমুল সতর্কতায় জীবনানন্দ পার হয়ে যাচ্ছিলেন ঐতিহ্যের পরিচিত ধারা-উপধারা; তাঁর কাব্যে প্রখর সচেতনতায় বর্জন করেছিলেন, বরিশালের এক বাঙালির পক্ষে যা অচিন্ত্যনীয়: বর্ষা ঋতু। আদি রোমান্টিকতার অবসান ঘোষণা করে তাঁর কাব্য পরিহার করে যায় বসন্ত ঋতু, গোলাপের মত ফুল বা কোকিলের মত পাখি নয় তো দক্ষিণ সমীরণ! কেননা তা রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয়। তবু আমি বলব এ সমস্ত তাঁর প্রসাধন চর্চা। শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময় আমাদের সভ্যতাকে যে সমস্ত মেধাবী যন্ত্রণা উপহার দিয়েছে তা কখনও উত্তর কলকাতার মেসবাড়ি, কখনও রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে সৌন্দর্যের সারাৎসার: নশ্বরতা থেকে অমরতা। বরিশাল থেকে কলকাতা - সাতটি তারার তিমির শুধু ভৌগোলিক স্থানান্তরণ নয়; এই স্থানান্তরণ ইতিহাসের একধরনের রূপান্তরণ। নাগরিকতার এ ধরনের অভিব্যক্তি কখনই উজ্জয়িনী বা এথেন্সে ছিল না। পাপের ফুল্লকুসুমিত প্যারিস অথবা ট্রামলাইন মথিত কলকাতা এমন এক ইতিহাস চেতনার পরিসর যে আমরা নিশ্চিত হই বোদলেয়ার বা জীবনানন্দ সময়ের প্রভু’।

       এই শহরে থাকা নিয়েই তাঁর একটি অনন্য কবিতা আছে – সেই কবিতা যেন তারই জীবনের রোজনামচা – তবু বুকের মধ্যে কোন ভগবান বা ঈশ্বর নয়, শুধু সেই স্বপ্নময় নদী ধানসিঁড়ি থাকে জেগে ।
কবিতাটির নাম –‘চিরদিন শহরেই থাকি’ । আসরের পাঠকদের জন্যে তুলে দিলাম -।
---------------
কবি জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতা
চিরদিন শহরেই থাকি
--------------
চিরদিন শহরেই থাকি
পড়ে থাকি পাটের আড়তে
করি কেরানির কাজ—শুভে-লাভে যদি কোনোমতে
দিন যায় চ’লে
আকাশের তলে
নক্ষত্রেরা কয় কোন্‌ কথা
জোৎস্নায় প্রাণের জড়তা
ব্যথা কেন পায়
সে সব খবর নিয়ে কাজ কিবা হায়
বিয়ে হয়েছিল কবে—মরে গেছে বউ
যদিও মহুয়া গাছে ফুটে ওঠে মৌ
একবার ঝরে গেলে তবু তারপর
মহুয়া মহুয়া তবু : কেরানির ঘর
কেরানির ঘর শুধু হায়
জীবনের গল্প শুধু একবার আসে—শুধু একবার নীল কুয়াশায়
নিঃশেষে ফুরায়।
দেবতা ভজি না আমি
তীর্থ করি নাকো
তোমরা ঠাকুর নিয়ে থাকো।
তবু আমি একবার ছুটি পেয়ে বেড়াবার তরে
গেলাম খানিকটা দূর—তারকেশ্বরে
গভীর অসাধ নিয়ে—গাঢ় অনিচ্ছায়
ট্রেনে আমি চড়িলাম হায়
কলরবে ধোঁয়ার ধূলায়
সাধ ক’রে কে বা মিছে যায়
জানি না ঈশ্বর কে বা—জানি শুধু ভুখা ভগবান
দিনগত পাপক্ষয় ক’রে পাব ত্রাণ
তারপর একদিন নিমতলা ঘাটে
কিংবা কাশি মিত্রের তল্লাটে
পড়ে রব
তবুও যখন আমি ঢের রাতে ফিরিলাম ঘর
বুকে জাগে সেই দেশ : তারকেশ্বর
দেবতারে কে খুঁজেছে—সারাদিন ঘুরিয়াছি পথে
অবসন্ন ধুলোর জগতে
অসংখ্য ভিড়ের মাঝে আমি
একখানা মুখ দেখে গিয়েছি যে থামি
সিংহের মূর্তির কাছে তাহারে ফেলেছি দেখে
দেখিয়াছি কবে যেন দেবতার পায়ে তা’রে
এশিরিয়া ব্যাবিলনে আমি
দেখেছি মিশরে
ঈসিসের ঘরে
সারাদিন—দিনমান আজ এই তারকেশ্বরে
আবার তাহার মুখ দেখিলাম, (আহা,)
ধানসিড়ি নদীটির বিকেল বেলার মৌন জলে
বেতের ফলের মতো যেই চোখ, যেই রূপ
ধরা দেয় পৃথিবীর নীরব আঁচলে
দেখিলাম তাহা
আবার তাহার মুখ দেখিলাম, আহা।

                                         (চলবে)