***************
মানুষের জীবনে দূর্ভাগ্য যখন আসে তখন যেন দূর্ভাগ্য বাঁধভাঙা জলের ধারার মতোই আসে । কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনে যেন সেই কথাটি চরম সত্যরূপে বারবার ফিরে এসেছে । প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি তাঁর সিটি কলেজে তার চাকরিটি হারান। কলকাতার সাহিত্যমণ্ডলেও সে সময় তাঁর রচিত কবিতা এক কঠিন সমালোচনার সম্মুখীন হয়। ‘সে সময়ের বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক সাহিত্য সমালোচক সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠি নামক পত্রিকায় তাঁর রচনার নির্দয় সমালোচনা করতে থাকেন’ ।
‘তাঁর প্রথম সন্তান কন্যা মঞ্জুশ্রী যখন জন্মে সেই সময়েই তাঁর ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং সাথে সাথেই তা কলকাতার সাহিত্যসমাজে বিপুলভাবে নেতিবাচক সমালোচনার শিকার হয়। কবিতাটির বিষয়বস্তু ছিল জোছনা রাতে হরিণ শিকার’। অনেকেই কবিতাটিকে অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করে কবিকে তুলোধুনো করেন।
‘তাঁর কবিতাকে নিয়ে শনিবারের চিঠির নগ্ন সমালোচনাই মুলতঃ আরেক ইতিবাচক প্রভাবও সৃষ্টি করেছিল তা’ আজ মানতেই হবে, আর তা হলো এই সমালোচানার কারণেই তৎকালীন সাহিত্যের পরিমণ্ডলে যারাই শনিবারের চিঠিকে অপছন্দ করতেন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই ক্কবি জীবনানন্দ দাশ এর কবিতা ও রচনা সম্পর্কে বেশ আগ্রহান্বিত হয়ে ওঠেন এবং পঞ্চপাণ্ডব কবির অপরাপর সবাই, বিশেষ করে কবি বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর রচনাকে কোলকাতার সাহিত্য অঙ্গণে আরো বেশী পরিমাণে প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন’ ।
‘বলাবাহুল্য যে, শনিবারের চিঠির সবচেয়ে বড় টার্গেট ছিলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই আর নব্য আধুনিক কবি সম্প্রদায় । ফলে কবি জীবনানন্দ দাশ বিশ্বকবিরও সুনজরে ছিলেন । ক্রমশ বাংলা সাহিত্যের ভূবনে তাঁর বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। সাতটি তারার তিমির প্রকাশিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুবোর্ধ্যতার অভিযোগ ওঠে’।
‘নিজ কবিতার অপমূল্যায়ন নিয়ে কবি জীবনানন্দ খুব ভাবিত ছিলেন। তিনি নিজের অর্থেই তাঁর রচনার প্রকাশের আগ্রহী ছিলেন যদিও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। কবি নিজেই নিজ রচনার সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন। ‘সারাজীবনে সাড়ে আট শত কবিতার বেশী কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। এমনকি ‘রূপসী বাংলার’ সম্পূর্ণ প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি তৈরীকৃত থাকা সত্ত্বেও তা প্রকাশের আয়োজন করেননি কবি। তিনি এ কাব্যগ্রন্থটির নাম দিয়েছিলেন ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ যা তার মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় এবং ‘রূপসী বাংলা’ নামে প্রকাশিত হয়। আরেকটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় মৃত্যু পরবর্তীকালে যা ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ নামে প্রকাশিত হয়’।
তাঁর একটি খুবই স্বল্প পঠিত কবিতা আমাকে টানে খুউব, কবিতাটির নামই ‘কবিতা’ । কবিতা’কে দিলাম তুলে আসরের পাতায়ঃ
কবি জীবনানন্দ দাশ’এর কবিতা
-------------------
কবিতা
আমাদের হাড়ে এক নির্ধূম আনন্দ আছে জেনে
পঙ্কিল সময়স্রোতে চলিতেছি ভেসে;
তা না হলে সকলই হারায়ে যেত ক্ষমাহীন রক্তে--নিরুদ্দেশে।
হে আকাশ,একদিন ছিলে তুমি প্রভাতের তটিনীর;
তারপর হয়ে গেছ দূর মেরুনিশীথের স্তব্ধ সমুদ্রের।
ভোরবেলা পাখিদের গানে তাই ভ্রান্তি নেই,
নেই কোনো নিষ্ফলতা আলোকের পতঙ্গের প্রাণে।
বানরী ছাগল নিয়ে যে ভিক্ষুক প্রতারিত রাজপথে ফেরে--
আজলায় স্থির শান্ত সলিলের অন্ধকার--
খুঁজে পায় জিজ্ঞাসার মানে।
চামচিকা বার হয় নিরালোকে ওপারের বায়ু সন্তরণে;
প্রান্তরের অমরতা জেগে ওঠে একরাশ প্রাদেশিকা ঘাসের উন্মেষে;
জীর্ণতম সমাধির ভাঙা ইট অসম্ভব পরগাছা ঘেঁষে
সবুজ সোনালি চোখ ঝিঁ-ঝিঁ-দম্পতির ক্ষুধা করে আবিষ্কার।
একটি বাদুড় দূর স্বোপার্জিত জোছনার মনীষায় ডেকে নিয়ে যায়
যাহাদের যতদুর চক্রবাল আছে লভিবার।
হে আকাশ,হে আকাশ
একদিন ছিলে তুমি মেরুনিশীথের স্তব্ধ সমুদ্রের মতো;
তারপর হয়ে গেছ প্রভাতের নদীটির মতো পতিভার।
‘কবিতা’ নামের এই কবিতায় পাঠকের, কবিদের, সাহিত্যমনস্কদের মনে কবিতার যে কী জোয়ারের টানের মতো অনুভব, কী অসাধারণ আত্মসম্পৃক্ততা তা যেন বিপুল বিভায় ফুটে উঠেছে ।
(চলবে)
[সূত্রঃ মুক্তবিশ্বকোষ, বিবিধ অনলাইন ব্লগস ও কবি জীবনী