***************
কবি জীবনানন্দ আত্মচরিত এখন অনলাইনে নানান ব্লগে সুলভ । আমি এখানে তাঁর আত্মচরিত নিয়ে ঠিক রচনাটিকে ভারী করতে চাই না, কারণ তাঁর জীবন খুব সুখের ছিল না । আমার বুকের ভেতর যে কবিকে নিয়ে সারাক্ষণ ঘুরি সেই কবির জীবনী পাঠ করতে আমার ভাল লাগে না, বলতেও ভাল লাগে না । অমন দুঃখের জীবন যেন কোন কবিরই না হয়।  
অতি দারিদ্র্যতায় সৃজনশীলতা মরে যেতে বাধ্য – একথা দারিদ্র্যের কষাঘাতে যারা একটুও ভুগেছেন তাঁরা জানেন ও উপলদ্ধি করতে পারেন ,  অন্যেরা নয় । এমন কঠোর দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি কী অদম্য প্রেরণায় তাঁর সৃজন কর্মকে এমন দূর নক্ষত্রে নিয়ে পৌঁছাতে পেরেছিলেন তা একমাত্র হয়তো তিনিই জানতেন । আর কারো তা জানার উপায় নেই । আমরা আজ শুধু তাঁর লেখা পড়ে কত রকম মতামত জানাতে পারি, কিন্তু আমরা কেউই তাঁর বেদনার সহচর ছিলাম না । তাই অনুমানও করতে পারি না, কী কঠিন জীবনবেদনার গাঢ় উচ্চারণ এইসকল কবিতা ।
জীবনানন্দ গবেষকেরা নানাভাবে তাঁর এই দারিদ্র্যতা বনাম সৃজনশীলতাকে নিয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পেয়েছেন। আমি তাঁদের সকল মতামতের সাথে একমত নাহয়েও বলতে পারি, সেই কল্লোল যুগেই যারা কবি হিসাবে সুনাম অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে কবি জীবনানন্দের মতো এমন দারিদ্র্যের ছোবল আর কোন কবিকে সহ্য করতে হয়নি । আমরা বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম আরেক নক্ষত্রকেও  দেখি এমন কঠোর দারিদ্র্যের যাতনায় কষ্ট পেতে – তিনি বিদ্রোহী কবি নজরুল । কবি নজরুলের জীবন ও সৃজন কর্মতো সেই ছোবলে শেষই হয়ে গেলো । এমনই বিধ্বংসী সেই ছোবল । না’হলে আজ কবি নজরুলের সাহিত্য ভাণ্ডার বাংলা সাহিত্যের সিন্দুকে আরো কত মণিমানিক্য যে যোগ করতে সক্ষম হতো তা’ আমরা উপলদ্ধি নিশ্চয়ই করতে পারি ।
লাবণ্যদেবীর সাথে ১৯৩০ সালে বিবাহের পরই তিনি তাঁর দিল্লী রামযশ কলেজের চাকরিতে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । হয়তো তাঁর সেই সিদ্ধান্তই কাল হলো । এরপর তিনি আর কোন চাকরিতেই টিকে থাকতে পারলেন না, কর্জ করে ব্যবসা করতে গিয়ে মূলধনই খোয়ালেন । সত্যিকারের কবিকে দিয়ে  কি ব্যবসা হয় ? আরো যদি সে কবি হন জীবনানন্দ ! জীবনের চাকা সচল রাখার চেষ্টায় তিনি বীমা কোম্পানির দালালের চাকরি পর্যন্ত নিয়েছিলেন । কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস তিনি তাতেও টিকে থাকতে পারেন নি ।
কিন্তু সেই চরম হতাশার দিনগুলোতেও তিনি লিখেছিলেন বেশ কিছু গল্প, উপন্যাস ও গীতিকবিতার মত লেখা, যা তিনি জীবদ্দশায় কখনো সূর্যের আলোয় বের করেন নি । কবি জীবনানন্দ তাঁর পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রজমোহন কলেজে ১৯৩৫ সালে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ঠিক সেই সময়েই কলকাতায় বুদ্ধদেব বসু,প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সমর সেন  নতুন কবিতা পত্রিকা বের করার আয়োজন করছিলেন,নাম দেয়া হয় ‘কবিতা’। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ নামাকৃত একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। সেই কবিতাটি পাঠ করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি বুদ্ধদেব বসুকে লেখা একটি চিঠিতে মন্তব্য করেছিলেন যে, কবিতাটি ছিল ‘চিত্ররূপময়’।
তাঁর একটি অনন্যসাধারণ কবিতা আমাকে নিয়ে যায় এক রূপকল্পময় বিষাদমাখা ভুবনে,  যখনই পড়ি । মনে প্রশ্ন জাগে, তিনি কি সারাক্ষণই তখন মৃত্যুচিন্তায় নিরত ছিলেন !  কবিতাটির নাম ‘মনে হয় একদিন আকাশের’ । কবিতাটি আসরের সত্যিকার কাব্যানুরাগীদের জন্যে তুলে দিলাম – বিশেষতঃ যারা আগে পড়ার সুযোগ পাননি তাঁদের জন্যে । পড়ে দেখুন তো – কেমন অভিজ্ঞতা হয় ।
মনে হয় একদিন আকাশের
– কবি জীবনানন্দ দাস
-------------------------------------------

মনে হয় একদিন আকাশের
শুকতারা দেখিব না আর;
দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ
থেকে এক ঝাড় জোনাকি কখন
নিভে যায়;-দেখিব না আর
আমি পরিচিত এই বাঁশবন,
শুকনো বাঁশের পাতা-
ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আঁধার
আমার চোখের কাছে;-
লক্ষ্মীপূর্ণিমা’র রাতে সে কবে আবার
পেঁচা ডাকে জ্যোৎস্নায়;-
হিজলের বাঁকা ডাল করে গুঞ্জরণ;
সারা রাত কিশোরীর লাল পাড়
চাঁদে ভাসে-হাতের কাঁকন
বেজে ওঠে : বুঝিব না-গঙ্গাজল,
নারকোল নাডুগুলো তার
জানি না সে কারে দেবে-
জানি না সে চিনি আর
শাদা তালশাঁস
হাতে লয়ে পলাশের
দিকে চেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে রবে
আবার কাহার সাথে ভালোবাসা হবে তার-
আমি তা জানি না-
মৃত্যুরে কে মনে রাখে?…
কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো
নতুন ডাঙার দিকে-পিছনের
অবিরল মৃত চর বিনা
দিন তার কেটে যায়-
শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ ?
                                         (চলবে)