***************

              কবি বিষ্ণু দে মানুষের জীবন যাতনার নানাদিক সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তিনি জীবনের সেই ক্লিষ্টতার দিকটি তাঁর রচনায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন । তাঁর কবিতায়, লেখনীতে ঊঠে এসেছে যাতনা তাড়িত জীবনের ছবি ।
               তাঁর কবিতার দর্শন ছিলো যুক্তিনির্ভর ও সমাজের সামগ্রিক উত্তরণের প্টভুমিতে ।
কাব্য সমালোচক বীরেন মুখার্জি বলেন, “বিষ্ণু দের কাব্যভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তার নিজস্ব যুক্তিবাদী দর্শন ও সামাজিক কল্যাণবোধ। একজন কবিও যে চিন্তার সুস্পষ্টতা, স্বচ্ছতা ও যুক্তিবাদী দর্শনের মাধ্যমে কবিতায় অতলস্পর্শী সাফল্য অর্জন করতে পারেন, বিষ্ণু দে তার উজ্জ্বল উদাহরণ। যে কারণে তার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দসমবায়ে এক ধরনের সৌম রুচির সন্ধান মেলে। কট্টর মার্কসবাদী সংস্কৃতি অঙ্গনের কেউ কেউ এলিয়টকে অবক্ষয় ও প্রতিক্রিয়াশীল কবি হিসেবে চিহ্নিত করলেও বিষ্ণু দের অভিমত ছিল এর বিপরীতে। তিনি এলিয়টকে আধুনিক সাহিত্যের মহৎ কবি মনে করতেন। মনে করতেন বাস্তব জীবনের রূপকার এবং বস্তুবাদী চৈতন্যের ধারক। বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে ব্যাপক ও প্রচ্ছন্ন সহমর্মিতা এবং এ প্রভাবের সদর্থক দিকের পাশাপাশি বিষ্ণু দের কবিতায় জটিলতার দিকটিও লক্ষ্যণীয়।
                 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বিষ্ণু দের মননেও গভীর রেখাপাত করে। সামাজিক দায়বদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ কবি ব্যক্তিবাদী সীমাবদ্ধতার দেয়াল ভেঙে সমষ্টিচেতনায় উঠে আসেন। সাধারণ মানুষের কাতারে উত্তরণ ঘটে কবিচিন্তার। কবিতায় সগর্বে উঠে আসে গণজাগরণের কাব্যকথা। সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের মানবিক আবেদন এবং বলিষ্ঠ ভাষ্যে প্রকাশ পায় শ্রেণীসংগ্রামের নির্দেশনা।

              তার শ্রেণীচেতন মানসিকতার সফল রূপায়ণ মৌভোগ কবিতায় তিনি ভাগচাষীদের যন্ত্রণা তুলে ধরেছেন যা পরে তেভাগা আন্দোলনে প্রেরণা জোগায়। কবিতায় লালকমল-নীলকমলের মাধ্যমে তিনি অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের সংগ্রামী চেতনা তুলে ধরেন-
জন্মে তাদের কৃষাণ শুনি কাস্তে বানায় ইস্পাতে
কৃষাণের বউ পঁইছে বাজু বানায়।
যাত্রা তাদের কঠিন পঠে রাখীবাঁদা কিশোর হাতে
রাক্ষসেরা বৃথাইরে নখ শানায়।...
এদিকে ওড়ে লালকমলের নীলকমলের হাতে
ভায়ের মিলে প্রাণের লালনিশান।
তাদের কথা হাওয়ায়, কৃষাণ কাস্তে বানায় ইস্পাতে
কামারশালে মজুর ধরে গান।

                কবিতাটিতে তিনি অন্ত্যজ শ্রেণীর কৃষকের কাস্তেকে পুঁজিবাদের শাণিত তরবারির সঙ্গে তুলনা করেছেন। এছাড়া শেষ স্তবকটি অসাম্প্র্রদায়িক চেতনা বিকাশের পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের রূপকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে কারণে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের অনুষঙ্গে কবিতাটি হয়ে উঠেছে শ্রেণীসংগ্রামের প্রতীকীকাব্য। আবার হাসনাবাদেই শীর্ষক কবিতায়ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ-আন্দোলনের ছবি ফুটে ওঠে। লালকমলের হাতে নীলকমলের রাখী বেঁধে অতন্দ্র রাম ও রহিম পঙ্ক্তির মাধ্যমে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা দেন। তার স্বদেশচিন্তা মার্কসবাদী চেতনার দর্পণে বিম্বিত হওয়ার কারণে তিনি সফল হয়ে ওঠেন।

কার পদধ্বনি আসে? কার?
একি মখ যুগান্তর! নব অবতার।
এ যে দস্যুদল!
হে ভদ্রা আমার!
লুব্ধ যাযাবর!
নির্ভীক আশ্বাসে আসে ঐশ্বর্য-লুণ্ঠনে,
দ্বারকার অঙ্গনে অঙ্গনে
চায় তারা রঙ্গিলাকে প্রিয়া ও জননী
প্রাণৈশ্বর্যে ধনী,
চায় তারা ফসলের ক্ষেত, দীঘি ও খামার
চায় সোনা-জ্বালা খনি। চায় স্থিতি অবসর!... চোখে আজ কুরুক্ষেত্র, কানে তার মত্ত পদধ্বনি
ক্ষমা কোরো অতিক্রান্ত জীর্ণ অসুয়ারে।
ব্যর্থ ধনঞ্জয় আজ, হে ভদ্রা আমার!
হে সঞ্চয়, ব্যর্থ আজ গাণ্ডীব অক্ষয়॥ (পদধ্বনি/ পূর্বলেখ)

               সাহিত্য সমালোচক দীপ্তি ত্রিপাঠির মতে- ‘পদধ্বনি’তে বিষ্ণু দে অর্জুনের প্রতীকে আসন্ন বিপ্লবের সম্মুখীন বুর্জোয়ার ক্লৈব্যের ছবি এঁকেছেন। পদধ্বনি এখানে তাই শোষিত সমষ্টির সামাজিক বিপ্লবেরই পদধ্বনি। বিষ্ণু দে দীক্ষিত কবি যেমন স্বাদেশিকতায় তেমনি আন্তর্জাতিকতায়। বিষয়ের ব্যাপকতায়, নানা ভাষ্যে এবং একাধিক প্রতীকে। তার কবিতায় মানবিক প্রাণের স্পন্দন প্রভাবসঞ্চারী পাশাপাশি দেশজাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষ মানুষের জয়গানে একাত্ম। মার্কসীয় দর্শনে প্রভাবিত হলেও তিনি বিশ্বাস করতেন সবার ওপরে মানুষ সত্য”।

                 এই পর্ব্বের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পঞ্চপাণ্ডব কবির অন্যতম প্রধান কবি বিষ্ণু দে’র উপরে আলোচনা । এই শেষের বেলায় আসরে শেয়ার করতে চাই কবির অন্যতম বিখ্যাত কবিতা ‘উর্বশী’ যা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে আমরা খুব আবৃত্তি করতাম নানা সাহিত্য সভায় এবং কবিতাটি সঙ্গতভাবেই যুবসমাজে বেশ সমাদৃত কবিতা ছিল ।

উর্বশী
আমি নহি পুরূরবা। হে উর্বশী,
ক্ষনিকের মরালকায়
ইন্দ্রিয়ের হর্ষে,জান গড়ে তুলি আমার ভুবন?
এসো তুমি সে ভুবনে,কদম্বের রোমাঞ্চ ছড়িয়ে।
ক্ষণেক সেখানে থাকো,
তোমার দেহের হায় অন্তহীন আমন্ত্রণবীথি
ঘুরি যে সময় নেই- শুধু তুমি থাকো ক্ষণকাল,
ক্ষণিকের আনন্দাঅলোয়
অন্ধকার আকাশসভায়
নগ্নতায় দীপ্ত তনু জ্বালিয়ে যাও
নৃত্যময় দীপ্ত দেয়ালিতে।
আর রাত্রি,রবে কি উর্বশী,
আকাশের নক্ষত্রাঅভায়,রজনীর শব্দহীনতায়
রাহুগ্রস্ত হয়ে রবে বহুবন্ধে পৃথিবীর নারী
পরশ-কম্পিত দেহ সলজ্জ উত্সুক?
আমি নহি পুরূরবা। হে উর্বশী,
আমরণ আসঙ্গলোলুপ,
আমি জানি আকাশ-পৃথিবী
আমি জানি ইন্দ্রধনু প্রেম আমাদের।
                                                                                    (চলবে)